ঢাকা ১২:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাওয়া না পাওয়ার ২০২০

মতামতঃ   মাত্র কয়েক দিন পর ২০২০ সাল বিদায় নেবে। এটি এমন একটি বছর, যা সারা বিশ্বের মানুষ ভুলে যেতে চাইবে, কিন্তু ভুলতে পারবে না।

কারণ এই বছর কভিড-১৯ নামের একটি অতিমারির কারণে দুনিয়াকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশ্বের অতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বা নেতা-নেত্রী সবাই এই অতিমারির কাছে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত। সারা বিশ্বে এই অতিমারিতে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে তিন লাখ ৩০ হাজার। বড়দিন ও নববর্ষের ছুটিতে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আনন্দ-ফুর্তির জন্য দিগ্বিদিক ছুটছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে আর সপ্তাহ দু-একের মধ্যে সেই দেশে আরো হাজার দশেক মানুষ প্রাণ হারাতে পারে।

সেই দেশের অনেক রাজ্যের মানুষ মাস্ক ব্যবহারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করে। এই যখন অবস্থা, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গলফ খেলতে গেলেন ফ্লোরিডা, আর করোনা অতিমারি দমনের দায়িত্বে নিয়োজিত টাস্কফোর্সের প্রধান দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ছুটি কাটাচ্ছেন কলোরাডোয়। আবার উল্টো চিত্রও আছে। শুরুতে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ও ফিলিপাইন ঘোষণা করেছে, সরকার ঘোষিত সুরক্ষা ব্যবস্থা না মানলে গুলি করা হবে।

এই আইন এখন উত্তর কোরিয়ায় বলবৎ করা হয়েছে। এই অতিমারি শুধু যে জীবনহানি ঘটিয়েছে তা-ই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দেশি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সব বন্ধ থেকেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতি এই বছর কমপক্ষে ৫.৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। বাড়বে বেকারত্ব, গৃহহীনের সংখ্যা; আর কমবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ। অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশে প্রাইমারি পর্যায়ে ঝরে পড়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে। এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা খুব যে বিবেচনাপ্রসূত হয়েছে তা বলা যাবে না। একটু চেষ্টা করলে পরীক্ষা নেওয়ার কিছু সৃজনশীল পদ্ধতি হয়তো উদ্ভাবন করা সম্ভব ছিল। তেমন কোনো চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এই অটো পাস শিক্ষার্থীরা হবে আগামী দিনের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার; যাবে উচ্চশিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রে।

এ তো গেল কভিড-১৯ জনিত সংকটের কথা। এর বাইরে ক্ষমতার মোহাচ্ছন্ন রাজনীতির কারণে সারা বিশ্বে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী প্রতি চার বছর পর সেই দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশটিতে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে। সদ্যঃসমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের প্রার্থী ছিলেন বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই। যুক্তরাষ্ট্রের জটিল নির্বাচন পদ্ধতির সুবাদে তিনি ২০১৬ সালে সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ট্রাম্প একজন ভালো ও সফল ব্যবসায়ী। তবে তিনি প্রমাণ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন নেই বা তাঁর মতো প্রেসিডেন্ট থাকা না থাকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

তাঁর প্রতিটি কথা বাস্তবতা এবং অনেক ক্ষেত্রে শালীনতাবর্জিত, যা অন্য কোনো দেশের রাজনীতিবিদের মুখে তেমন একটা শোনা যায় না। নির্বাচনের আগে তিনি ঘোষণা করলেন, পরাজিত হলে তিনি ফলাফল মেনে নেবেন না। নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হলেন। তিনি মানতে নারাজ। হতেই পারে না। তাঁর মতে, এটি ব্যাপক কারচুপির ফল।

এমন অভিযোগ খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে, যারা সারা বিশ্বকে নিয়মিত গণতন্ত্র, স্বচ্ছ রাজনীতি ও নির্বাচনের সবক দেয়। নিজেদের প্রয়োজনে আধুনিক বোমারু বিমান ও ট্যাংকের পিঠে অন্য দেশে গণতন্ত্র রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় সে দেশ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠায় সব কিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য। আর আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও সুধীজন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে গণতন্ত্র গেল গেল বলে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে শুনানিতে গিয়ে সাক্ষ্য দেন। নালিশ নিয়ে হাজির হন পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতদের দরজায়।

ট্রাম্প নিজের মামলা নিয়ে গেলেন সেই দেশের আদালতে। আদালত যেন তাঁর পক্ষে থাকেন সেই লক্ষ্যে তিনি দেশের শীর্ষ আদালতে তাঁর নিজের পছন্দ করা বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে রেখেছিলেন। ‘কারচুপি’র মামলা আদালতে গেলে সব আদালত সাফ জানিয়ে দিলেন—‘এসবের কোনো প্রমাণ নেই। ফলাফল মেনে নিয়ে বিদায় হও।’ তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়ার পাত্র নন। তিনি এখন চিন্তা করছেন দেশে সামরিক আইন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক প্রশাসক ঘোষণা করার জন্য। আগামী ২০ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই দিন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেবেন।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কভিড-১৯ মার্চ মাসে হামলা করল বাংলাদেশে। শুরুতে সরকার সব কিছু বস্তুতপক্ষে বন্ধ ঘোষণা করল। বাঙালি সব সময় অনেকটা বেপরোয়া। সরকার নানা ধরনের সুরক্ষার পরামর্শ দিয়েই চলেছে। বাংলাদেশেও দ্রুত কভিড-১৯ ছড়াল, তবে সরকারের কিছু ত্বরিত ব্যবস্থা, যেমন সব ধরনের দেশি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধকরণ, কোথাও কোথাও লকডাউন ঘোষণা, দেশের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য নিয়োগ দেওয়া, এর দেখাদেখি অন্যান্য বেসরকারি সাহায্য ও সেবাদানকারী সংস্থার এগিয়ে আসা পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছুটা সহায়তা করেছে। এর জন্য একক কৃতিত্বের দাবিদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি পুরো সময় ধরে এই সংকট মোকাবেলা করার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন।

বাংলাদেশে কভিড-১৯ আক্রমণের শুরুর দিকে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেকটা অবচেতনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার কারণে বর্তমানে তারা অনেকটা শুরুর দিককার সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠেছে।

তবে তাদের প্রকৃত কর্মক্ষমতা প্রমাণিত হবে দেশে কভিড-১৯-এর টিকা আনা ও তার বণ্টন ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রচারিত অনলাইন মিডিয়া পোর্টাল ব্লুমবার্গ গত ২০ ডিসেম্বর এক জরিপের ফল প্রকাশ করে বিশ্বকে জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাসে কভিড-১৯ সমস্যা মোকাবেলায় যে কটি দেশ সাফল্য দেখিয়েছে তার প্রথম ৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম, আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। প্রথম স্থানে অবস্থান করছে দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড। গত এক বছর তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে তাইওয়ান। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের ওপরে আছে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড।

বাংলাদেশের জনগণ যদি আরো একটু সচেতন হতো, তাহলে আমাদের দেশের অবস্থান আরো একটু ভালো হতে পারত। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের অবস্থান ২৪তম ছিল। এই সূচক প্রস্তুত করার সময় যেসব উপাত্তকে ব্লুমবার্গ গুরুত্ব দিয়েছে তার মধ্যে আছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত না করে অতিমারি মোকাবেলা করার বিদ্যমান ব্যবস্থা, টিকাপ্রাপ্তি ও তার ব্যবহার ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি। ভারত, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের নিচে অবস্থান করছে।

সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখন আইএমএফ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করেছে এ বছর বিশ্বে মাত্র ২৯টি দেশের ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, যার মধ্যে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করবে। শুরুতে রপ্তানি খাত হোঁচট খেলেও তাতে এখন গতি ফিরেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ৪২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা একটি নতুন রেকর্ড। ঘরের ও বাইরের শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে পদ্মা সেতুর ওপর বসল সর্বশেষ স্প্যান। অবাক বিস্ময়ে সারা দুনিয়ার মানুষ দেখল, যে দেশের ৩০ লাখ মানুষ নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন দিতে পারে সেই দেশ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে পদ্মা সেতুর মতো এমন সব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে, তাও আবার নিজস্ব অর্থায়নে। এর জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব। দেশ স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর সেই দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা।

এতসব ভালো ও মন্দ খবরের মধ্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক খবর হচ্ছে দেশের এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা আর রাজনীতিবিদদের লাগামহীন দুর্নীতি। সুখের বিষয় হচ্ছে, সরকার চেষ্টা করছে এই দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনতে। আর বছর যখন শেষ হয়ে আসছে তখন দেশে শুরু হলো কিছু ধর্মব্যবসায়ী তস্করের আস্ফাালন। উদ্দেশ্য একটাই—সরকারের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা। এদেরও কঠোর হস্তে দমন করা সময়ের দাবি। ভালো-মন্দ মিলিয়ে বছরটা গেল।

তবে এমন বছর আর যেন আগামী দিনে না আসে সে-ই প্রার্থনা। ভালো দিনের অপেক্ষায় সবাইকে নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা।

আবদুল মান্নান,

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

সূত্রঃকালের কন্ঠ

 

ট্যাগস

পাওয়া না পাওয়ার ২০২০

আপডেট সময় ০৮:৫৩:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০

মতামতঃ   মাত্র কয়েক দিন পর ২০২০ সাল বিদায় নেবে। এটি এমন একটি বছর, যা সারা বিশ্বের মানুষ ভুলে যেতে চাইবে, কিন্তু ভুলতে পারবে না।

কারণ এই বছর কভিড-১৯ নামের একটি অতিমারির কারণে দুনিয়াকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশ্বের অতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বা নেতা-নেত্রী সবাই এই অতিমারির কাছে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত। সারা বিশ্বে এই অতিমারিতে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে তিন লাখ ৩০ হাজার। বড়দিন ও নববর্ষের ছুটিতে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আনন্দ-ফুর্তির জন্য দিগ্বিদিক ছুটছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে আর সপ্তাহ দু-একের মধ্যে সেই দেশে আরো হাজার দশেক মানুষ প্রাণ হারাতে পারে।

সেই দেশের অনেক রাজ্যের মানুষ মাস্ক ব্যবহারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করে। এই যখন অবস্থা, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গলফ খেলতে গেলেন ফ্লোরিডা, আর করোনা অতিমারি দমনের দায়িত্বে নিয়োজিত টাস্কফোর্সের প্রধান দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ছুটি কাটাচ্ছেন কলোরাডোয়। আবার উল্টো চিত্রও আছে। শুরুতে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ও ফিলিপাইন ঘোষণা করেছে, সরকার ঘোষিত সুরক্ষা ব্যবস্থা না মানলে গুলি করা হবে।

এই আইন এখন উত্তর কোরিয়ায় বলবৎ করা হয়েছে। এই অতিমারি শুধু যে জীবনহানি ঘটিয়েছে তা-ই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দেশি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সব বন্ধ থেকেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতি এই বছর কমপক্ষে ৫.৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। বাড়বে বেকারত্ব, গৃহহীনের সংখ্যা; আর কমবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ। অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশে প্রাইমারি পর্যায়ে ঝরে পড়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে। এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা খুব যে বিবেচনাপ্রসূত হয়েছে তা বলা যাবে না। একটু চেষ্টা করলে পরীক্ষা নেওয়ার কিছু সৃজনশীল পদ্ধতি হয়তো উদ্ভাবন করা সম্ভব ছিল। তেমন কোনো চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এই অটো পাস শিক্ষার্থীরা হবে আগামী দিনের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার; যাবে উচ্চশিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রে।

এ তো গেল কভিড-১৯ জনিত সংকটের কথা। এর বাইরে ক্ষমতার মোহাচ্ছন্ন রাজনীতির কারণে সারা বিশ্বে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী প্রতি চার বছর পর সেই দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশটিতে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে। সদ্যঃসমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের প্রার্থী ছিলেন বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই। যুক্তরাষ্ট্রের জটিল নির্বাচন পদ্ধতির সুবাদে তিনি ২০১৬ সালে সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ট্রাম্প একজন ভালো ও সফল ব্যবসায়ী। তবে তিনি প্রমাণ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন নেই বা তাঁর মতো প্রেসিডেন্ট থাকা না থাকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

তাঁর প্রতিটি কথা বাস্তবতা এবং অনেক ক্ষেত্রে শালীনতাবর্জিত, যা অন্য কোনো দেশের রাজনীতিবিদের মুখে তেমন একটা শোনা যায় না। নির্বাচনের আগে তিনি ঘোষণা করলেন, পরাজিত হলে তিনি ফলাফল মেনে নেবেন না। নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হলেন। তিনি মানতে নারাজ। হতেই পারে না। তাঁর মতে, এটি ব্যাপক কারচুপির ফল।

এমন অভিযোগ খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে, যারা সারা বিশ্বকে নিয়মিত গণতন্ত্র, স্বচ্ছ রাজনীতি ও নির্বাচনের সবক দেয়। নিজেদের প্রয়োজনে আধুনিক বোমারু বিমান ও ট্যাংকের পিঠে অন্য দেশে গণতন্ত্র রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় সে দেশ থেকে পর্যবেক্ষক পাঠায় সব কিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য। আর আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও সুধীজন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে গণতন্ত্র গেল গেল বলে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে শুনানিতে গিয়ে সাক্ষ্য দেন। নালিশ নিয়ে হাজির হন পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতদের দরজায়।

ট্রাম্প নিজের মামলা নিয়ে গেলেন সেই দেশের আদালতে। আদালত যেন তাঁর পক্ষে থাকেন সেই লক্ষ্যে তিনি দেশের শীর্ষ আদালতে তাঁর নিজের পছন্দ করা বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে রেখেছিলেন। ‘কারচুপি’র মামলা আদালতে গেলে সব আদালত সাফ জানিয়ে দিলেন—‘এসবের কোনো প্রমাণ নেই। ফলাফল মেনে নিয়ে বিদায় হও।’ তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়ার পাত্র নন। তিনি এখন চিন্তা করছেন দেশে সামরিক আইন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক প্রশাসক ঘোষণা করার জন্য। আগামী ২০ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই দিন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেবেন।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কভিড-১৯ মার্চ মাসে হামলা করল বাংলাদেশে। শুরুতে সরকার সব কিছু বস্তুতপক্ষে বন্ধ ঘোষণা করল। বাঙালি সব সময় অনেকটা বেপরোয়া। সরকার নানা ধরনের সুরক্ষার পরামর্শ দিয়েই চলেছে। বাংলাদেশেও দ্রুত কভিড-১৯ ছড়াল, তবে সরকারের কিছু ত্বরিত ব্যবস্থা, যেমন সব ধরনের দেশি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধকরণ, কোথাও কোথাও লকডাউন ঘোষণা, দেশের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য নিয়োগ দেওয়া, এর দেখাদেখি অন্যান্য বেসরকারি সাহায্য ও সেবাদানকারী সংস্থার এগিয়ে আসা পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছুটা সহায়তা করেছে। এর জন্য একক কৃতিত্বের দাবিদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি পুরো সময় ধরে এই সংকট মোকাবেলা করার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন।

বাংলাদেশে কভিড-১৯ আক্রমণের শুরুর দিকে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেকটা অবচেতনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার কারণে বর্তমানে তারা অনেকটা শুরুর দিককার সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠেছে।

তবে তাদের প্রকৃত কর্মক্ষমতা প্রমাণিত হবে দেশে কভিড-১৯-এর টিকা আনা ও তার বণ্টন ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রচারিত অনলাইন মিডিয়া পোর্টাল ব্লুমবার্গ গত ২০ ডিসেম্বর এক জরিপের ফল প্রকাশ করে বিশ্বকে জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাসে কভিড-১৯ সমস্যা মোকাবেলায় যে কটি দেশ সাফল্য দেখিয়েছে তার প্রথম ৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম, আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। প্রথম স্থানে অবস্থান করছে দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড। গত এক বছর তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে তাইওয়ান। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের ওপরে আছে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড।

বাংলাদেশের জনগণ যদি আরো একটু সচেতন হতো, তাহলে আমাদের দেশের অবস্থান আরো একটু ভালো হতে পারত। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের অবস্থান ২৪তম ছিল। এই সূচক প্রস্তুত করার সময় যেসব উপাত্তকে ব্লুমবার্গ গুরুত্ব দিয়েছে তার মধ্যে আছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত না করে অতিমারি মোকাবেলা করার বিদ্যমান ব্যবস্থা, টিকাপ্রাপ্তি ও তার ব্যবহার ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি। ভারত, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের নিচে অবস্থান করছে।

সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখন আইএমএফ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করেছে এ বছর বিশ্বে মাত্র ২৯টি দেশের ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, যার মধ্যে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করবে। শুরুতে রপ্তানি খাত হোঁচট খেলেও তাতে এখন গতি ফিরেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ৪২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা একটি নতুন রেকর্ড। ঘরের ও বাইরের শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে পদ্মা সেতুর ওপর বসল সর্বশেষ স্প্যান। অবাক বিস্ময়ে সারা দুনিয়ার মানুষ দেখল, যে দেশের ৩০ লাখ মানুষ নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন দিতে পারে সেই দেশ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে পদ্মা সেতুর মতো এমন সব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে, তাও আবার নিজস্ব অর্থায়নে। এর জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব। দেশ স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর সেই দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা।

এতসব ভালো ও মন্দ খবরের মধ্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক খবর হচ্ছে দেশের এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা আর রাজনীতিবিদদের লাগামহীন দুর্নীতি। সুখের বিষয় হচ্ছে, সরকার চেষ্টা করছে এই দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনতে। আর বছর যখন শেষ হয়ে আসছে তখন দেশে শুরু হলো কিছু ধর্মব্যবসায়ী তস্করের আস্ফাালন। উদ্দেশ্য একটাই—সরকারের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা। এদেরও কঠোর হস্তে দমন করা সময়ের দাবি। ভালো-মন্দ মিলিয়ে বছরটা গেল।

তবে এমন বছর আর যেন আগামী দিনে না আসে সে-ই প্রার্থনা। ভালো দিনের অপেক্ষায় সবাইকে নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা।

আবদুল মান্নান,

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

সূত্রঃকালের কন্ঠ