ঢাকা ১২:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জনতার বিপ্লব নয় জনআতঙ্ক ছিল ৭ নভেম্বর: মোস্তফা

জনতার বিপ্লব নয় জনআতঙ্ক ছিল ৭ নভেম্বর: মোস্তফা

স্টাফ রিপোর্টার:  ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব হয়েছিল, এমনটাই প্রচার করে ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের বেনিফিশিয়ারিরা। তাত্ত্বিক আলোচনা করবো না। নিজের দেখা ওই সময়ের কিছু দৃশ্য বর্ণনা করতে চাই, বিবেচনার জন্য।

যতটা মনে আসে, ওই সময় শীত পড়তে শুরু করেছিল। ৬ নভেম্বর রাতে সেনানিবাস সংলগ্ন ইব্রাহিমপুরে আমার চাচার বাসায় ছিলাম আমি। কয়েকদিনের অস্থিতিশীল অবস্থা এবং সেনানিবাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে চাচী ছিলেন খুবই উদ্বিগ্ন। চাচা ছিলেন কর্মসূত্রে তখন রাজশাহীতে। তাই চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে আমাকেও থাকতে হয়েছিলো আগে থেকেই।

৭ নভেম্বর আমাদের পুরো পরিবারই উৎকণ্ঠিত। মূল কারণ ছোট চাচা। তিনি থাকতেন স্টাফ রোডে অফিসার্স কোয়ার্টারে। ছোট চাচার কোনো খবর পাচ্ছি না আমরা। ছোট চাচার খোঁজ নিতে বলবেন এমন সাহস হয়তো চাচী করছিলেন না। ওই সময় কারো সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না। আর সবার বাসায় ফোনও ছিল না। ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল ঢাকাতে।

এরইমধ্যে সকাল ১০টার পর ইব্রাহিমপুর থেকে রওনা হই সেনানিবাসের দিকে। ওয়ার্কশপ এলাকা দিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখি রাস্তার দুইপাশে বাংকারে সৈনিকরা সশস্ত্র অবস্থানে। এই দৃশ্য আমার কাছে নতুন কিছু নয়। একাত্তরে এমন বাংকারে থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল আমারও। কিন্তু এটা তো একাত্তর নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন মুখোমুখি অবস্থান কেন? কার বিরুদ্ধে হবে যুদ্ধ? প্রতিপক্ষ কে?

হাঁটছি সিএমএইচ এর দিকে। রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি থাক দূরের কথা একটা বিড়ালও নেই। মানুষতো প্রশ্নই আসে না। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের কাছে গিয়ে ভয় বেড়ে যায়। ভাবলাম স্কুলের দক্ষিণে ধানক্ষেত দিয়ে বনানীর দিকে যাবো কিনা। কিন্তু ভয় হলো- সৈনিকরা যদি সন্দেহ করে গুলি করে বসে। বিপদের আশঙ্কা আছে।

তাই বড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই নিরাপদ। এক জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ি। লুকিয়ে যাই ছোট চাচার নাম পরিচয়। কারণ ওই বিদ্রোহটা হয়েছিলো অফিসারদের বিরুদ্ধে। সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। এমন স্লোগানও দিতে শুনেছি আগেই। সেই অবস্থায় যদি কোনো কর্নেলের নাম বলি তাহলে বিপদ হতে পারে। বলি, আমার ভাই সেনাবাহিনীতে আছেন। তাঁর খবর নিতে যাচ্ছি।

হাঁটতে হাঁটতে বাশার রোড হয়ে স্টাফ রোড সংলগ্ন চেকপোস্টে সিপাহীরা পথরোধ করে নিয়ে যায় বক্সে। অফিসার্স কোয়ার্টারে যাবো মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই মূলত আমাকে বক্সে নিয়ে যায়। গ্রামের ঠিকানাও জানতে চায় কর্তব্যরত সৈনিকেরা। এরমধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে কোন বাড়ি। হালে পানি পাই। সেই ব্যক্তি আমাদের গ্রামের। এবং ছোট চাচার বাসায় তার যাতায়াতও ছিল। তিনিও সুযোগ বুঝে কিছুটা উপদেশ দিলেন। যাক ছাড়া পেলাম সেখান থেকে। সামান্য দূরেই লম্বা স্কুল ঘরের মতো একেকটি দেয়ালঘেরা টিনশেড বাড়ি।

গেইটের সামনে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বাসার সামনের রাস্তায় আগে মাঝে মাঝে গরু চড়তে দেখতাম। রাস্তায় সেই গরুও নেই। মানুষ তো দূরের কথা। জানিনা ঢাকা শহরের সৃষ্টির পর এমন ফাঁকা রাস্তা কোনোকালে ছিলো কি না। ময়মনসিংহ রোডেও (বিমান বন্দর) কোনো গাড়িঘোড়া চোখে পড়েনি। ইতস্তত করে কলিংবেল না টিপে গেইটে নাড়া দিলাম। ভিতর থেকে কোনো শব্দ নেই। কয়েকবার নাড়া দিতে বুঝতে পারলাম, পকেট গেটও লাগানো হয়নি। তারপরও না ঢুকে কলিংবেল টিপলাম, পরিস্থিতি বোঝার জন্য।

ভিতর থেকে আওয়াজ এলো কে? কণ্ঠটা ছোট চাচার গেটম্যানের। ভয়টা বেড়ে গেলো। অতি দ্রুত খারাপ চিন্তা হতে থাকে। বেটম্যানরা অসংখ্য অফিসারকে হত্যা করেছে বলে শুনেছি। সেও কি ছোট চাচাকে খুনটুন করেনি তো? যাই হোক পরিচয় দিতেই পেছন থেকে বেরিয়ে আসে বেটম্যান। কী মনে করে আমাকে সে বাসার ভিতরে নিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে কার্পেটের উপর এলোমেলো বিছানার চাদর বিছানো। বাসায় পিনপতন নীরবতা।

বেটম্যান কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কিভাবে এলেন। তার কণ্ঠ শুনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। কণ্ঠে উগ্রতা কিংবা ভয় পাওয়ার লক্ষণ নেই। চাচার কথা জিজ্ঞেস করলাম। জবাব দিলেন, তিনি গোপনীয় জায়গায় আছেন। এক পর্যায়ে বললেন, আপনি এলিফেন্ট রোড যেতে পারেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার এলাম ময়মনসিংহ রোডে। মহাখালীর দিকে হাঁটছি। হঠাৎ একটা দেড়টনি ট্রাক আসতে দেখলাম কুর্মিটোলার দিক থেকে। অনেক মানুষ ট্রাকে। অনুমান করছিলাম হাত দেখালে থামবে না। তাই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে দাঁড়াই। বাধ্য হয় থামতে। ধাক্কাধাক্কি করে ট্রাকে চড়ি। কিন্তু মহাখালী বাঁকে এসে ট্রাক থেমে যায়। থার্ডগেট দিয়ে সে শহরে ঢুকবে না। তখন তেজগাঁয়ের রাস্তা ছিল না। রেললাইনের পাশে ঝিলে নেমে কাদা পারিয়ে যাই নাখালপাড়া ফুপুর বাসায়। ফুপু তাঁর ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করছেন। সব জেনে বললেন, তিনি যাবেন এলিফেন্ট রোড। কিন্তু ফুপার বকা খেলেন। বাসায় বাধা পেয়ে নিবৃত হলেন।

এয়ারপোর্ট এসে অপেক্ষা করছি, কোনো গাড়ি দেখা যায় কি না। রাস্তার পূর্বদিকে ছিল খোলা জায়গায় তিনটি পাকা দোকান। দোকানের পাশে ৩/৪জন কিশোর ও একজন মধ্যবয়সি পুরুষ। মনে হচ্ছিল পরিস্থিতি দেখার জন্য এসেছে কৌতূহলী হয়ে। এরমধ্যেই একটা লড়ির শব্দ। থেমে যায় দোকানের সামনে এসে।

এমন সময় ডাক দিলো কিশোরদের লক্ষ্য করে। আমি দ্রুত নিজেকে দোকানের পেছনে আড়াল করে নেই। কিশোররা ইতস্তত করে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। মধ্যবয়সের ভদ্রলোক আরও ধীরে যেতে থাকে। ইশারা দেখে মনে হচ্ছিলো কিশোরদের ডাকছে তাদের সঙ্গী হতে। ট্রাকে চড়লো ওরা। ওরা এগিয়ে যেতে আমি আবার রাস্তায় নামি। সংসদ ভবনের সামনে ( প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) যেতে দেখি আরও কিছু মানুষকে ডেকে উঠিয়ে নিচ্ছে তারা।

এলিফেন্ট রোড চাচার বাসায় ঢোকার আগেই দেখি বাড়িতে কয়েকজন টুপিধারী মানুষ। আতঙ্ক বেড়ে যায়। চাচার কিছু হলো না তো। বড় চাচাকে দেখলাম টুপি পরেই বারান্দায় বসে আছেন। জানলাম ছোট চাচীর অকাল বাচ্চা প্রসব হয়েছে এবং বাচ্চাটা মারা গেছে। কিন্তু দাদা ( চাচাতো ভাই উইং কমান্ডার মোস্তফা আনোয়ার) এবং ছোট চাচাকে দেখছি না।

বড় চাচা বললেন, কাছাকাছি আছেন ছোট চাচা। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে গেলাম বড় চাচার বাসার পরের গলিতে মংলা বন্ধরের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ইছহাক সাহেবের বাসায়। ভাবছিলাম দাদাও সেখানে থাকতে পারেন। কারণ ইছহাক সাহেব তার ভায়রা ভাই। গিয়ে দেখলাম- ছোট চাচা ও ব্রিগেডিয়ার বারি সাহেব ( পরবর্তিকালে ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত)। কিন্তু দাদা ওখানে নেই। তিনি সম্ভবত গ্রিনরোডে কোনো বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।

ছোট চাচা বললেন, বাটার মোড়ে লিফলেট বিতরণ হয়েছে। সেখানে গিয়ে যেন লিফলেট নিয়ে আসি। আর গোপনীয়তা বজায় রাখতে সতর্ক করে দিলেন আমাকে। বাটার মোড়ে এসে দেখি ট্যাংক দাঁড়িয়ে আছে একটা। উৎসুক মানুষ ভিড় করেছে ট্যাংক দেখে। রাস্তায়ও এক দুইজন মানুষ বেরিয়েছে পরিস্থিতি দেখার জন্য। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ট্যাংক এর উপরে উৎসুক মানুষকে চড়তে দেখা। কি কারণে জানি না সৈনিকরা মানুষকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রাস্তায় পরে থাকা একটা লিফলেট কুড়িয়ে নেই। যতটা মনে আসে, সেখানে লেখা ছিলো শহিদ মিনার কিংবা কোথাও সমাবেশ হবে এমন কিছু। লিফলেটটা ছোটচাচার হাতে দিয়ে কাঁটাবন,হাতিরপুল রেললাইন দিয়ে নাখালপাড়া এসে রাত কাটাই।

একান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এটা। তবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে-এই ঢাকার ওইদিনের চিত্রে কি জনতার উপস্থিতি ছিলো? ট্যাংক আর মিলিটারি লড়ি ফাঁকা রাস্তায় চালানোর নাম কি সিপাহী জনতার বিপ্লব? জনতার বিপ্লব হলে অফিসারদের রক্ত চাওয়া স্লোগান কেন? বেটম্যান প্রথা বাতিলের দাবির সঙ্গে জনতার সম্পৃক্ততা কোথায়। বেটম্যান প্রথা বাতিল করে কি জনতার বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছিল?

ট্যাংকে চড়া সাধারণ মানুষের ছবি দেখিয়ে জনতার বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠার সঙ্গে খুব মনে পড়ে বাসন্তির কথা। যে বাসন্তিকে শাড়ির চেয়ে বেশি দামের জাল পরিয়ে দুর্ভিক্ষকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এর মাত্র বছরকাল আগে। দৃঢ় বিশ্বাস ১৯৭৫ সালের সামরিক শাসকদের ক্ষমতার লড়াইকে জনভিত্তি দেওয়ার চেষ্টারও একই পরিণতি হবে। কারণ ওর সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। জনতার বিপ্লবতো দূরের কথা-জনতার আতঙ্কই ছিল ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরের বড় পরিচয়।

 

ট্যাগস

জনতার বিপ্লব নয় জনআতঙ্ক ছিল ৭ নভেম্বর: মোস্তফা

আপডেট সময় ১২:২৬:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ নভেম্বর ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার:  ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব হয়েছিল, এমনটাই প্রচার করে ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের বেনিফিশিয়ারিরা। তাত্ত্বিক আলোচনা করবো না। নিজের দেখা ওই সময়ের কিছু দৃশ্য বর্ণনা করতে চাই, বিবেচনার জন্য।

যতটা মনে আসে, ওই সময় শীত পড়তে শুরু করেছিল। ৬ নভেম্বর রাতে সেনানিবাস সংলগ্ন ইব্রাহিমপুরে আমার চাচার বাসায় ছিলাম আমি। কয়েকদিনের অস্থিতিশীল অবস্থা এবং সেনানিবাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে চাচী ছিলেন খুবই উদ্বিগ্ন। চাচা ছিলেন কর্মসূত্রে তখন রাজশাহীতে। তাই চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে আমাকেও থাকতে হয়েছিলো আগে থেকেই।

৭ নভেম্বর আমাদের পুরো পরিবারই উৎকণ্ঠিত। মূল কারণ ছোট চাচা। তিনি থাকতেন স্টাফ রোডে অফিসার্স কোয়ার্টারে। ছোট চাচার কোনো খবর পাচ্ছি না আমরা। ছোট চাচার খোঁজ নিতে বলবেন এমন সাহস হয়তো চাচী করছিলেন না। ওই সময় কারো সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না। আর সবার বাসায় ফোনও ছিল না। ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল ঢাকাতে।

এরইমধ্যে সকাল ১০টার পর ইব্রাহিমপুর থেকে রওনা হই সেনানিবাসের দিকে। ওয়ার্কশপ এলাকা দিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখি রাস্তার দুইপাশে বাংকারে সৈনিকরা সশস্ত্র অবস্থানে। এই দৃশ্য আমার কাছে নতুন কিছু নয়। একাত্তরে এমন বাংকারে থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল আমারও। কিন্তু এটা তো একাত্তর নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন মুখোমুখি অবস্থান কেন? কার বিরুদ্ধে হবে যুদ্ধ? প্রতিপক্ষ কে?

হাঁটছি সিএমএইচ এর দিকে। রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি থাক দূরের কথা একটা বিড়ালও নেই। মানুষতো প্রশ্নই আসে না। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের কাছে গিয়ে ভয় বেড়ে যায়। ভাবলাম স্কুলের দক্ষিণে ধানক্ষেত দিয়ে বনানীর দিকে যাবো কিনা। কিন্তু ভয় হলো- সৈনিকরা যদি সন্দেহ করে গুলি করে বসে। বিপদের আশঙ্কা আছে।

তাই বড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই নিরাপদ। এক জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ি। লুকিয়ে যাই ছোট চাচার নাম পরিচয়। কারণ ওই বিদ্রোহটা হয়েছিলো অফিসারদের বিরুদ্ধে। সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। এমন স্লোগানও দিতে শুনেছি আগেই। সেই অবস্থায় যদি কোনো কর্নেলের নাম বলি তাহলে বিপদ হতে পারে। বলি, আমার ভাই সেনাবাহিনীতে আছেন। তাঁর খবর নিতে যাচ্ছি।

হাঁটতে হাঁটতে বাশার রোড হয়ে স্টাফ রোড সংলগ্ন চেকপোস্টে সিপাহীরা পথরোধ করে নিয়ে যায় বক্সে। অফিসার্স কোয়ার্টারে যাবো মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই মূলত আমাকে বক্সে নিয়ে যায়। গ্রামের ঠিকানাও জানতে চায় কর্তব্যরত সৈনিকেরা। এরমধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে কোন বাড়ি। হালে পানি পাই। সেই ব্যক্তি আমাদের গ্রামের। এবং ছোট চাচার বাসায় তার যাতায়াতও ছিল। তিনিও সুযোগ বুঝে কিছুটা উপদেশ দিলেন। যাক ছাড়া পেলাম সেখান থেকে। সামান্য দূরেই লম্বা স্কুল ঘরের মতো একেকটি দেয়ালঘেরা টিনশেড বাড়ি।

গেইটের সামনে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বাসার সামনের রাস্তায় আগে মাঝে মাঝে গরু চড়তে দেখতাম। রাস্তায় সেই গরুও নেই। মানুষ তো দূরের কথা। জানিনা ঢাকা শহরের সৃষ্টির পর এমন ফাঁকা রাস্তা কোনোকালে ছিলো কি না। ময়মনসিংহ রোডেও (বিমান বন্দর) কোনো গাড়িঘোড়া চোখে পড়েনি। ইতস্তত করে কলিংবেল না টিপে গেইটে নাড়া দিলাম। ভিতর থেকে কোনো শব্দ নেই। কয়েকবার নাড়া দিতে বুঝতে পারলাম, পকেট গেটও লাগানো হয়নি। তারপরও না ঢুকে কলিংবেল টিপলাম, পরিস্থিতি বোঝার জন্য।

ভিতর থেকে আওয়াজ এলো কে? কণ্ঠটা ছোট চাচার গেটম্যানের। ভয়টা বেড়ে গেলো। অতি দ্রুত খারাপ চিন্তা হতে থাকে। বেটম্যানরা অসংখ্য অফিসারকে হত্যা করেছে বলে শুনেছি। সেও কি ছোট চাচাকে খুনটুন করেনি তো? যাই হোক পরিচয় দিতেই পেছন থেকে বেরিয়ে আসে বেটম্যান। কী মনে করে আমাকে সে বাসার ভিতরে নিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে কার্পেটের উপর এলোমেলো বিছানার চাদর বিছানো। বাসায় পিনপতন নীরবতা।

বেটম্যান কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কিভাবে এলেন। তার কণ্ঠ শুনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। কণ্ঠে উগ্রতা কিংবা ভয় পাওয়ার লক্ষণ নেই। চাচার কথা জিজ্ঞেস করলাম। জবাব দিলেন, তিনি গোপনীয় জায়গায় আছেন। এক পর্যায়ে বললেন, আপনি এলিফেন্ট রোড যেতে পারেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার এলাম ময়মনসিংহ রোডে। মহাখালীর দিকে হাঁটছি। হঠাৎ একটা দেড়টনি ট্রাক আসতে দেখলাম কুর্মিটোলার দিক থেকে। অনেক মানুষ ট্রাকে। অনুমান করছিলাম হাত দেখালে থামবে না। তাই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে দাঁড়াই। বাধ্য হয় থামতে। ধাক্কাধাক্কি করে ট্রাকে চড়ি। কিন্তু মহাখালী বাঁকে এসে ট্রাক থেমে যায়। থার্ডগেট দিয়ে সে শহরে ঢুকবে না। তখন তেজগাঁয়ের রাস্তা ছিল না। রেললাইনের পাশে ঝিলে নেমে কাদা পারিয়ে যাই নাখালপাড়া ফুপুর বাসায়। ফুপু তাঁর ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করছেন। সব জেনে বললেন, তিনি যাবেন এলিফেন্ট রোড। কিন্তু ফুপার বকা খেলেন। বাসায় বাধা পেয়ে নিবৃত হলেন।

এয়ারপোর্ট এসে অপেক্ষা করছি, কোনো গাড়ি দেখা যায় কি না। রাস্তার পূর্বদিকে ছিল খোলা জায়গায় তিনটি পাকা দোকান। দোকানের পাশে ৩/৪জন কিশোর ও একজন মধ্যবয়সি পুরুষ। মনে হচ্ছিল পরিস্থিতি দেখার জন্য এসেছে কৌতূহলী হয়ে। এরমধ্যেই একটা লড়ির শব্দ। থেমে যায় দোকানের সামনে এসে।

এমন সময় ডাক দিলো কিশোরদের লক্ষ্য করে। আমি দ্রুত নিজেকে দোকানের পেছনে আড়াল করে নেই। কিশোররা ইতস্তত করে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। মধ্যবয়সের ভদ্রলোক আরও ধীরে যেতে থাকে। ইশারা দেখে মনে হচ্ছিলো কিশোরদের ডাকছে তাদের সঙ্গী হতে। ট্রাকে চড়লো ওরা। ওরা এগিয়ে যেতে আমি আবার রাস্তায় নামি। সংসদ ভবনের সামনে ( প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) যেতে দেখি আরও কিছু মানুষকে ডেকে উঠিয়ে নিচ্ছে তারা।

এলিফেন্ট রোড চাচার বাসায় ঢোকার আগেই দেখি বাড়িতে কয়েকজন টুপিধারী মানুষ। আতঙ্ক বেড়ে যায়। চাচার কিছু হলো না তো। বড় চাচাকে দেখলাম টুপি পরেই বারান্দায় বসে আছেন। জানলাম ছোট চাচীর অকাল বাচ্চা প্রসব হয়েছে এবং বাচ্চাটা মারা গেছে। কিন্তু দাদা ( চাচাতো ভাই উইং কমান্ডার মোস্তফা আনোয়ার) এবং ছোট চাচাকে দেখছি না।

বড় চাচা বললেন, কাছাকাছি আছেন ছোট চাচা। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে গেলাম বড় চাচার বাসার পরের গলিতে মংলা বন্ধরের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ইছহাক সাহেবের বাসায়। ভাবছিলাম দাদাও সেখানে থাকতে পারেন। কারণ ইছহাক সাহেব তার ভায়রা ভাই। গিয়ে দেখলাম- ছোট চাচা ও ব্রিগেডিয়ার বারি সাহেব ( পরবর্তিকালে ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত)। কিন্তু দাদা ওখানে নেই। তিনি সম্ভবত গ্রিনরোডে কোনো বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।

ছোট চাচা বললেন, বাটার মোড়ে লিফলেট বিতরণ হয়েছে। সেখানে গিয়ে যেন লিফলেট নিয়ে আসি। আর গোপনীয়তা বজায় রাখতে সতর্ক করে দিলেন আমাকে। বাটার মোড়ে এসে দেখি ট্যাংক দাঁড়িয়ে আছে একটা। উৎসুক মানুষ ভিড় করেছে ট্যাংক দেখে। রাস্তায়ও এক দুইজন মানুষ বেরিয়েছে পরিস্থিতি দেখার জন্য। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ট্যাংক এর উপরে উৎসুক মানুষকে চড়তে দেখা। কি কারণে জানি না সৈনিকরা মানুষকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রাস্তায় পরে থাকা একটা লিফলেট কুড়িয়ে নেই। যতটা মনে আসে, সেখানে লেখা ছিলো শহিদ মিনার কিংবা কোথাও সমাবেশ হবে এমন কিছু। লিফলেটটা ছোটচাচার হাতে দিয়ে কাঁটাবন,হাতিরপুল রেললাইন দিয়ে নাখালপাড়া এসে রাত কাটাই।

একান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এটা। তবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে-এই ঢাকার ওইদিনের চিত্রে কি জনতার উপস্থিতি ছিলো? ট্যাংক আর মিলিটারি লড়ি ফাঁকা রাস্তায় চালানোর নাম কি সিপাহী জনতার বিপ্লব? জনতার বিপ্লব হলে অফিসারদের রক্ত চাওয়া স্লোগান কেন? বেটম্যান প্রথা বাতিলের দাবির সঙ্গে জনতার সম্পৃক্ততা কোথায়। বেটম্যান প্রথা বাতিল করে কি জনতার বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছিল?

ট্যাংকে চড়া সাধারণ মানুষের ছবি দেখিয়ে জনতার বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠার সঙ্গে খুব মনে পড়ে বাসন্তির কথা। যে বাসন্তিকে শাড়ির চেয়ে বেশি দামের জাল পরিয়ে দুর্ভিক্ষকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এর মাত্র বছরকাল আগে। দৃঢ় বিশ্বাস ১৯৭৫ সালের সামরিক শাসকদের ক্ষমতার লড়াইকে জনভিত্তি দেওয়ার চেষ্টারও একই পরিণতি হবে। কারণ ওর সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। জনতার বিপ্লবতো দূরের কথা-জনতার আতঙ্কই ছিল ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরের বড় পরিচয়।