ঢাকা ০৫:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাষার প্রথমগানের গীতিকার শামসুদ্দিন আজও স্বীকৃতি পাননি

রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি, তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।’ এই গানের রচয়িতা ভাষা সৈনিক হিসাবে ৭ দশকেও পাননি স্বীকৃতি। আর বড় ছেলে ৬৮ বছরেও পাননি বয়স্ক ভাতা। রোগ শোক, অভাব অনটন মাথায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা।

পাকিস্তান শাসনামলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির আন্দোলন জনরোষে রূপ নেয়। ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলের সময় পাক হানাদারের গুলিতে ঢাকার রাজপথে রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনার দিনই (২১শে ফেব্রুয়ারি) রাতেই বাগেরহাটের চারণ কবি শেখ সামছুদ্দিন আহমদ ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামে রচনা করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানটি।

পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বাগেরহাটের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করা হয়। এরপর বাগেরহাট সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক মাঠে প্রথমে প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের লেখা গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেন ছাত্র-জনতাকে। তার এ গান শুধু বাগেরহাটই নয় ঢাকাসহ দেশের সকল ছাত্র-জনতাকেই  উজ্জীবিত করেছিল।

এই গানের রচয়িতা চারণ কবি শামসুদ্দিন বাগেরহাটের খ্যাতিমান সন্তান। কবি শামসুদ্দিন আহমেদ ১৯১৫ সালে বাগেরহাট জেলা শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে ফতেপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন লেহাজ উদ্দিন সেখ এবং মাতা নুরজাহান বেগম। প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ও পরে বাগেরহাট টাউন হাই স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এখান থেকেই তিনি জুনিয়র পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল কবিতা ও গানের প্রতি অসাধারণ আগ্রহ।

পেশায় তিনি ছিলেন এক জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি হাটে-বাজারে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন আর গান গাইতেন। কেউ কেউ তাকে তেল বিক্রেতা বলেও উল্লেখ করেছেন।

তার এই ভাষার প্রথম গান বিশ্বের দরবারে অমর হয়ে থাকলেও ভাষা সৈনিক বা ভাষা সংগ্রামী হিসাবে জাতীয়ভাবে এখনো তালিকাভুক্ত হতে পারেননি বা মূল্যায়ন পাননি এই কবি। শুধু তাই নয়, তার পরিবার এখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে সরকারি সহযোগিতায়  শেখ সামছুদ্দিন আহমদের নামে একটি গেট করা হয়েছে। আর গেল বছর স্থানীয় সাংবাদিকরা তার দরিদ্রতা নিয়ে সংবাদ প্রচার করলে জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে তার পরিবারকে কিছু টিন এবং একটি অটোরিকশা প্রদান করা হয়। টিনগুলো ঘরের চালে লাগানো হলেও অভাবের তাড়নায় কিছুদিন পর অটোরিকশাটি বিক্রি করে দেন পরিবার।

১৯৭৪ সালে কবি সামসুদ্দিনের মৃত্যুর পর ১ মেয়ে ও ২ ছেলে রেখে যান। বড় মেয়ে লাইলি বেগম দুই বছর আগে মারা যান। বাড়িতে শুধু ৬৮ বছর বয়সী চারণ কবির বড় ছেলে দেলোয়ার হেসেন খোকন ও তার পরিবার বসবাস করেন। আর অভাব ঘুচাতে ছোট ছেলে মুকুল সেখ ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এখনও রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।

চারণ কবির বড় ছেলে খোকন বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয় বলে এখনো পর্যন্ত পাননি বয়স্ক ভাতা। জানতে চাইলে কবির পুত্রবধূ শিরিনা বেগম বলেন, আমাদের বয়স্ক ভাতা পাওয়ার দরকার নেই। অভাবে বাবার রেখে যাওয়া জমির কিছু অংশ বিক্রি করা হয়েছে। এখন মাত্র রয়েছে ২ কাঠা জমি। খোকনও অসুস্থ। জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অসুস্থ হওয়ায় আগের মতো কোনো কাজও করতে পারেন না। 

খোকনের প্রথম স্ত্রী ৩ সন্তান রেখে মারা যাবার পর আবার বিয়ে করলে সে ঘরে আরও ২ সন্তান জন্ম নেয়। বর্তমানে ২ সংসার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে জানান খোকন। তিনি  বলেন, ১৯৭৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অভাব যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আমাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়ায়নি। আমরা শুধু বড়ই হইছি কিন্তু মানুষ হইনি।

কবি সামসুদ্দিন ১৯৫৩ সালে খুলনার দি ইস্টার্ন প্রেস থেকে পাকিস্তান পল্লীগীতি নামে তার লেখা গানের একটি সংকলন প্রকাশ করেন। ১৬টি গান এ পুস্তিকায় ছাপা হয়।

কবি শামসুদ্দিনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়া তাসনিম জানান, গত বছর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সুপারিশ ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এরপর তাকে ঘর সংস্কারের জন্য টিন প্রদান ও আয় রোজগারের জন্য একটি অটোরিকশা প্রদান করা হয়েছে। জেলা উপজেলা প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে  বিভিন্ন সময়ে তাকে সহযোগিতা করে থাকে। আর বয়স্ক ভাতার ব্যাপারে ইতোমধ্যে সমাজসেবা অফিসারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি তাকে বয়স্ক ভাতার তালিকায় আনা হবে।

ট্যাগস

ভাষার প্রথমগানের গীতিকার শামসুদ্দিন আজও স্বীকৃতি পাননি

আপডেট সময় ১২:০৩:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি, তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।’ এই গানের রচয়িতা ভাষা সৈনিক হিসাবে ৭ দশকেও পাননি স্বীকৃতি। আর বড় ছেলে ৬৮ বছরেও পাননি বয়স্ক ভাতা। রোগ শোক, অভাব অনটন মাথায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা।

পাকিস্তান শাসনামলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির আন্দোলন জনরোষে রূপ নেয়। ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলের সময় পাক হানাদারের গুলিতে ঢাকার রাজপথে রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনার দিনই (২১শে ফেব্রুয়ারি) রাতেই বাগেরহাটের চারণ কবি শেখ সামছুদ্দিন আহমদ ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামে রচনা করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানটি।

পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বাগেরহাটের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করা হয়। এরপর বাগেরহাট সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক মাঠে প্রথমে প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের লেখা গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেন ছাত্র-জনতাকে। তার এ গান শুধু বাগেরহাটই নয় ঢাকাসহ দেশের সকল ছাত্র-জনতাকেই  উজ্জীবিত করেছিল।

এই গানের রচয়িতা চারণ কবি শামসুদ্দিন বাগেরহাটের খ্যাতিমান সন্তান। কবি শামসুদ্দিন আহমেদ ১৯১৫ সালে বাগেরহাট জেলা শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে ফতেপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন লেহাজ উদ্দিন সেখ এবং মাতা নুরজাহান বেগম। প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ও পরে বাগেরহাট টাউন হাই স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এখান থেকেই তিনি জুনিয়র পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল কবিতা ও গানের প্রতি অসাধারণ আগ্রহ।

পেশায় তিনি ছিলেন এক জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি হাটে-বাজারে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন আর গান গাইতেন। কেউ কেউ তাকে তেল বিক্রেতা বলেও উল্লেখ করেছেন।

তার এই ভাষার প্রথম গান বিশ্বের দরবারে অমর হয়ে থাকলেও ভাষা সৈনিক বা ভাষা সংগ্রামী হিসাবে জাতীয়ভাবে এখনো তালিকাভুক্ত হতে পারেননি বা মূল্যায়ন পাননি এই কবি। শুধু তাই নয়, তার পরিবার এখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে সরকারি সহযোগিতায়  শেখ সামছুদ্দিন আহমদের নামে একটি গেট করা হয়েছে। আর গেল বছর স্থানীয় সাংবাদিকরা তার দরিদ্রতা নিয়ে সংবাদ প্রচার করলে জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে তার পরিবারকে কিছু টিন এবং একটি অটোরিকশা প্রদান করা হয়। টিনগুলো ঘরের চালে লাগানো হলেও অভাবের তাড়নায় কিছুদিন পর অটোরিকশাটি বিক্রি করে দেন পরিবার।

১৯৭৪ সালে কবি সামসুদ্দিনের মৃত্যুর পর ১ মেয়ে ও ২ ছেলে রেখে যান। বড় মেয়ে লাইলি বেগম দুই বছর আগে মারা যান। বাড়িতে শুধু ৬৮ বছর বয়সী চারণ কবির বড় ছেলে দেলোয়ার হেসেন খোকন ও তার পরিবার বসবাস করেন। আর অভাব ঘুচাতে ছোট ছেলে মুকুল সেখ ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এখনও রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।

চারণ কবির বড় ছেলে খোকন বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয় বলে এখনো পর্যন্ত পাননি বয়স্ক ভাতা। জানতে চাইলে কবির পুত্রবধূ শিরিনা বেগম বলেন, আমাদের বয়স্ক ভাতা পাওয়ার দরকার নেই। অভাবে বাবার রেখে যাওয়া জমির কিছু অংশ বিক্রি করা হয়েছে। এখন মাত্র রয়েছে ২ কাঠা জমি। খোকনও অসুস্থ। জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অসুস্থ হওয়ায় আগের মতো কোনো কাজও করতে পারেন না। 

খোকনের প্রথম স্ত্রী ৩ সন্তান রেখে মারা যাবার পর আবার বিয়ে করলে সে ঘরে আরও ২ সন্তান জন্ম নেয়। বর্তমানে ২ সংসার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে জানান খোকন। তিনি  বলেন, ১৯৭৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অভাব যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আমাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়ায়নি। আমরা শুধু বড়ই হইছি কিন্তু মানুষ হইনি।

কবি সামসুদ্দিন ১৯৫৩ সালে খুলনার দি ইস্টার্ন প্রেস থেকে পাকিস্তান পল্লীগীতি নামে তার লেখা গানের একটি সংকলন প্রকাশ করেন। ১৬টি গান এ পুস্তিকায় ছাপা হয়।

কবি শামসুদ্দিনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়া তাসনিম জানান, গত বছর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সুপারিশ ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এরপর তাকে ঘর সংস্কারের জন্য টিন প্রদান ও আয় রোজগারের জন্য একটি অটোরিকশা প্রদান করা হয়েছে। জেলা উপজেলা প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে  বিভিন্ন সময়ে তাকে সহযোগিতা করে থাকে। আর বয়স্ক ভাতার ব্যাপারে ইতোমধ্যে সমাজসেবা অফিসারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি তাকে বয়স্ক ভাতার তালিকায় আনা হবে।