ঢাকা ১১:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গাজীপুরে রক্তাক্ত সন্ধ্যা -সাংবাদিক তুহিনকে জনসম্মুখে নির্মমভাবে হত্যা

গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার ব্যস্ততম মোড়। চারপাশে মানুষের ভিড়, যানবাহনের হর্ন, দোকানের ভেতরে ও বাইরে ক্রেতাদের কোলাহল। কিন্তু এই কোলাহলের মাঝেই ঘটল এক মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড, যা মুহূর্তেই স্তব্ধ করে দিল পুরো এলাকা। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত সাড়ে ৭টার দিকে ঈদগাহ মার্কেটের সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান তুহিন (৩২)।

তুহিন শুধু একজন সাংবাদিকই ছিলেন না—ছিলেন দুই সন্তানের স্নেহময় পিতা, একজন নিবেদিত স্বামী, সবার আপনজন। খবর সংগ্রহের ফাঁকে ফাঁকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন, যেন সংসারের প্রয়োজন মেটে। কিন্তু এই মানুষটিই একদল নির্মম সন্ত্রাসীর হাতে প্রাণ হারালেন, সবার সামনে, সাহায্যের হাত না পেয়ে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চান্দনা চৌরাস্তার এক প্রান্তে। বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি ও এক নারীর মধ্যে উত্তপ্ত বিবাদ চলছিল। হঠাৎ বাদশা মিয়া ওই নারীকে আঘাত করলে, নারীর পক্ষ নিয়ে কয়েকজন দুর্বৃত্ত দা-চাপাতি হাতে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে বাদশা মিয়া দৌড়ে পালিয়ে যান। আর এই মুহূর্তের ঘটনাই রাস্তার পাশ থেকে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক তুহিন—যিনি হয়তো জানতেন না, এই ভিডিওই তার জীবনের শেষ সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।

সন্ত্রাসীরা তুহিনকে দেখে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তুহিন সাহসিকতার সঙ্গে অস্বীকৃতি জানান। মুহূর্তেই শুরু হয় ধাওয়া। ব্যস্ত মোড়ের মানুষগুলো কেবল আতঙ্কে দাঁড়িয়ে দেখে—তুহিন দৌড়ে আশ্রয়ের খোঁজ করছেন, বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। শেষমেশ ঈদগাহ মার্কেটের এক চায়ের দোকানে ঢুকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা এসে পড়েছে—বুক, গলা, পিঠ, কাঁধে এলোপাতাড়ি কোপ, গলার কিছু অংশ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন তিনি—রক্তে ভিজে যায় দোকানের মেঝে।

ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষ তখনো চুপ। ভয়ে কেউ এগোয়নি। আর সন্ত্রাসীরা, যেন বিজয়ীর মতো, রক্তমাখা অস্ত্র হাতে এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন, “আমার ভাই কখনো কারো ক্ষতি করেনি, কেবল সত্য তুলে ধরতে চাইত। সেই সত্যের জন্যই আজ তাকে মরতে হলো।”

পুলিশ বলছে, এটি চাঁদাবাজি নয়, নারীঘটিত একটি ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে খুন করেছে। কিন্তু যে-ই হোক, যে কারণেই হোক—গাজীপুর হারাল এক সাহসী সাংবাদিক, যে সত্যের সঙ্গে আপস করতে জানত না।

এখন রয়ে গেছে শুধু রক্তমাখা সন্ধ্যার স্মৃতি, স্তব্ধ শহরের নীরবতা, আর তুহিনের দুই ছোট সন্তানের অনাথ চোখ—যেখানে প্রতিদিন ফিরে আসার কথা ছিল তাদের বাবার।

ট্যাগস

সর্বাধিক পঠিত

গাজীপুরে রক্তাক্ত সন্ধ্যা -সাংবাদিক তুহিনকে জনসম্মুখে নির্মমভাবে হত্যা

আপডেট সময় ১২:৩৬:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার ব্যস্ততম মোড়। চারপাশে মানুষের ভিড়, যানবাহনের হর্ন, দোকানের ভেতরে ও বাইরে ক্রেতাদের কোলাহল। কিন্তু এই কোলাহলের মাঝেই ঘটল এক মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড, যা মুহূর্তেই স্তব্ধ করে দিল পুরো এলাকা। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত সাড়ে ৭টার দিকে ঈদগাহ মার্কেটের সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান তুহিন (৩২)।

তুহিন শুধু একজন সাংবাদিকই ছিলেন না—ছিলেন দুই সন্তানের স্নেহময় পিতা, একজন নিবেদিত স্বামী, সবার আপনজন। খবর সংগ্রহের ফাঁকে ফাঁকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন, যেন সংসারের প্রয়োজন মেটে। কিন্তু এই মানুষটিই একদল নির্মম সন্ত্রাসীর হাতে প্রাণ হারালেন, সবার সামনে, সাহায্যের হাত না পেয়ে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চান্দনা চৌরাস্তার এক প্রান্তে। বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি ও এক নারীর মধ্যে উত্তপ্ত বিবাদ চলছিল। হঠাৎ বাদশা মিয়া ওই নারীকে আঘাত করলে, নারীর পক্ষ নিয়ে কয়েকজন দুর্বৃত্ত দা-চাপাতি হাতে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে বাদশা মিয়া দৌড়ে পালিয়ে যান। আর এই মুহূর্তের ঘটনাই রাস্তার পাশ থেকে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক তুহিন—যিনি হয়তো জানতেন না, এই ভিডিওই তার জীবনের শেষ সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।

সন্ত্রাসীরা তুহিনকে দেখে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তুহিন সাহসিকতার সঙ্গে অস্বীকৃতি জানান। মুহূর্তেই শুরু হয় ধাওয়া। ব্যস্ত মোড়ের মানুষগুলো কেবল আতঙ্কে দাঁড়িয়ে দেখে—তুহিন দৌড়ে আশ্রয়ের খোঁজ করছেন, বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। শেষমেশ ঈদগাহ মার্কেটের এক চায়ের দোকানে ঢুকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা এসে পড়েছে—বুক, গলা, পিঠ, কাঁধে এলোপাতাড়ি কোপ, গলার কিছু অংশ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন তিনি—রক্তে ভিজে যায় দোকানের মেঝে।

ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষ তখনো চুপ। ভয়ে কেউ এগোয়নি। আর সন্ত্রাসীরা, যেন বিজয়ীর মতো, রক্তমাখা অস্ত্র হাতে এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন, “আমার ভাই কখনো কারো ক্ষতি করেনি, কেবল সত্য তুলে ধরতে চাইত। সেই সত্যের জন্যই আজ তাকে মরতে হলো।”

পুলিশ বলছে, এটি চাঁদাবাজি নয়, নারীঘটিত একটি ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে খুন করেছে। কিন্তু যে-ই হোক, যে কারণেই হোক—গাজীপুর হারাল এক সাহসী সাংবাদিক, যে সত্যের সঙ্গে আপস করতে জানত না।

এখন রয়ে গেছে শুধু রক্তমাখা সন্ধ্যার স্মৃতি, স্তব্ধ শহরের নীরবতা, আর তুহিনের দুই ছোট সন্তানের অনাথ চোখ—যেখানে প্রতিদিন ফিরে আসার কথা ছিল তাদের বাবার।