মাদারীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থককে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। নিহত এসকেন্দার খাঁ মাদারীপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য।
এবারের ভোটে তিনি কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থক ছিলেন। তাহমিনা বেগম একাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।
নরসিংদী-৩ আসনের নৌকার প্রার্থী ফজলে রাব্বি খান নরসিংদী জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করেছেন যে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাঁকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি ২০১৪ সালেও স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তখন সিরাজুল ইসলাম কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ, হামলা ও মামলা করার ঘটনা ঘটছে।
গতকাল শনিবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে প্রকাশিত হয়েছে এমন হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা পাওয়া গেছে ২৫টি। এর মধ্যে ১৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকদের ওপর। ফেনী, ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, যশোর, মৌলভীবাজার ও মাদারীপুরে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে একটি হামলার ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুই পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে অন্তত পাঁচ জায়গায়।
এসব ঘটনায় ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। নির্বাচনে মোট ২৭টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। মোট প্রার্থী এক হাজার ৮৯৬ জন। এর মধ্যে ৩৪৭ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্রের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের পদধারী স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও রয়েছে দলীয় কর্মীর সমর্থন। এতে দুই পক্ষের শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে পড়ছে।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, একে অন্যকে না দেখতে পারাটা সমস্যা নয়। সমস্যা তখন হয় যখন এর কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। একজন মানুষ খুন হয়ে গেল। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নির্বাচন কমিশনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। যে প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে সেই প্রার্থীকে সতর্ক করতে হবে।
স্থানীয় রাজনীতির রেষারেষি চেপে রাখা যাচ্ছে না। একই রাজনৈতিক আদর্শের প্রার্থীরাও একে অন্যের ওপর হামলা চালাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অনুসারীরাও এক নেতার পক্ষে ছেড়ে আরেক পক্ষে ঝুঁকছেন। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে বড় ধরনের বিভাজন সৃষ্টিরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই বিভাজন নির্বাচনের পরও সক্রিয় থাকলে তা দলে দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতার ধারা তৈরি করতে পারে।
বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফিরোজুর রহমানের কাঁচি প্রতীকের পোস্টার ছিনিয়ে নেন পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সমপাদক শেখ মঞ্জুর ই মাওলা। তাঁকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফিরোজুর রহমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
ময়মনসিংহ-৯ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিতরণ করায় নান্দাইলের গাঙাইল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদেক হোসেন ভুইয়াকে নৌকার সমর্থকরা বইঠা দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছেন। পঞ্চগড়-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটকে সরিয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু সারোয়ার বকুলকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। রেলমন্ত্রী পঞ্চগড়-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এই ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাময়িকভাবে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। সাময়িক দূরতও্ব তৈরি হতে পারে। এটা পরে ঠিক হয়ে যাবে। এটা ভোটের রাজনীতির সংস্কৃতি। তিনি বলেন, ‘ভোটের সময় যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে এটা দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতা তৈরি করবে বলে আমি মনে করি না। নির্বাচন শেষে দলের নেতাকর্মীরা একজোট হয়ে কাজ করবে।’
গাজীপুরের টঙ্গীতে ভোটকেন্দ্রের সামনে লাগানো পোস্টারে আগুন দেওয়ায় নৌকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম। তিনি গাজীপুর মহানগর যুবলীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক। এই আসনে নৌকার প্রার্থী ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ হাসান রাসেল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তবে সেটা শান্তিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কোনো ধরনের পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা দল থেকে মেনে নেওয়া হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দল থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার মতো ঘটনা এবারই প্রথম। তাই নির্বাচন শেষে দলের এই বৈরিতার পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটা এখনই বলা কঠিন। এর আগে দু-এক জায়গায় যখন দলের প্রার্থী বিদ্রোহী হয়েছেন, তখন তাঁরা জিতে এলে দলে জায়গা পেতে দেখেছি। এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবার দল থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে আবার শিক্ষা নেওয়াও সম্ভব। প্রার্থীদের কেন নির্বাচন করতে দল থেকে ছাড় দেওয়া হবে না। আসলে তৃণমূল যদি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে জটিলতা বাড়বে না।’