প্রতি বছর নভেম্বর থেকে দেশে শুরু হয় লবণ উৎপাদন মৌসুম। ঘূর্ণিঝড় হামুন ও মিধিলির হানায় এবার শুরুতেই কিছুটা ছেদ পড়েছে উৎপাদনে। সে রেশ কাটতে না কাটতেই বঙ্গোপসাগরে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিগগির আসতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মিচাউং’।
প্রাকৃতিক কারণে ঠিকঠাক লবণ উৎপাদনে যেতে পারছেন না চাষিরা। আর উৎপাদন ব্যাহত হলে এর প্রভাব পড়তে পারে বাজারে। যদিও অগ্রিম সতর্কতা হিসেবে এরই মধ্যে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আমদানির অনুমতি পাওয়া লবণ পাইপলাইনে রয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখের মধ্যে এসব লবণ দেশে এসে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন লবণ মিল মালিকরা।
বড় আমদানিকারক ও লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমদানির অনুমতি পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠান এলসি খুলেছে। আশা করা হচ্ছে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে ওইসব লবণ দেশে পৌঁছাবে। এরই মধ্যে কিছু লবণ জাহাজীকরণ শুরু হয়েছে।’
উৎপাদন যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তাতে লবণের সংকট হতে পারে। এখন কারও হাতে লবণ নেই। আমদানি হবে সে খবরে বাজার স্থিতিশীল আছে। তবে উৎপাদন ঠিক না থাকলে দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।–আমদানিকারক তিনি বলেন, ‘দ্রুত দেশে আনতে ভারতের গুজরাট থেকে লবণ আমদানি হচ্ছে। আগামী মাসের পুরো সময় এসব লবণ দেশের চাহিদা মেটাবে। যতটুকু লবণ (এক লাখ টন) আসছে সেটা মাত্র ১২-১৫ দিনের চাহিদা মেটাবে। আরও বেশি পরিমাণে লবণ আনা প্রয়োজন ছিল।’
নুরুল কবির বলেন, ‘উৎপাদন যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তাতে লবণের সংকট হতে পারে। এখন কারও হাতে লবণ নেই। আমদানি হবে সে খবরে বাজার স্থিতিশীল আছে। তবে উৎপাদন ঠিক না থাকলে দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’ দেশে একমাত্র উৎপাদিত পণ্য লবণ, যা দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ পুরো দেশ। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কিছু জায়গা ও কক্সবাজারে উৎপাদন হয় এ লবণ। তবে উৎপাদনের সিংহভাগই হয় কক্সবাজারে। নভেম্বর থেকে মে মাস ধরা হয় লবণের মৌসুম। এখন আগামী মৌসুমের লবণ উৎপাদন চলছে। ২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন লবণ।
বিসিক প্রধান কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও লবণ সেলের প্রধান সারওয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার টন। এবছর চাহিদা ছিল ২৩ লাখ ৮৮ হাজার টন। যে কারণে মৌসুম শেষে সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’ ‘ডিসেম্বর মাসের জন্য দুই লাখ টন লবণের চাহিদা রয়েছে, কিন্তু আমাদের মজুত রয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার টন। উৎপাদন ঠিক থাকলে সমস্যা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এ মৌসুমের শুরুতেই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় হামুনের জন্য সিজন ১৫ দিন দেরি হয়, এরপর মিধিলি। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এখনো ভালোভাবে শুরু হয়নি উৎপাদন। এ পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার ৬৩৪ টন উৎপাদন হয়েছে, যা গত মৌসুমের এই সময়ের চেয়ে অনেক কম।’
সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের মাঠ প্রস্তুত। তবে আরেকটা ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এবার চাষিরা মাঠে নেমে দু’দফা ঘূর্ণিঝড় পেয়েছে। বারবার সমস্যা হচ্ছে। এখন ৮০ শতাংশ চাষি নতুন করে মাঠে নেমেছে। আবারও ঘূর্ণিঝড় আসছে। সব মিলে খুব সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি জানান, গত বছর ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। এবছর আরও বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতিক দুর্যোগের কারণে বারবার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শেষ মৌসুমে গত ৬২ বছরের মধ্যে দেশে রেকর্ড লবণ উৎপাদন হয়। তারপরও ক্রমাগত চাহিদা বাড়ায় লবণ সংকটের আশঙ্কা করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। যে কারণে লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় চাষি, মজুতদার ও মিল মালিকদের মধ্যে।
উৎপাদন যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তাতে লবণের সংকট হতে পারে। এখন কারও হাতে লবণ নেই। আমদানি হবে সে খবরে বাজার স্থিতিশীল আছে। তবে উৎপাদন ঠিক না থাকলে দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।–বিসিক লবণ সেলের প্রধান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ২২ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে লবণ চাষে গত ৬২ বছরে কখনো এত লবণ উৎপাদন হয়নি। সবশেষ ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল।
এরপরও লবণের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম। এ কারণে ৭ নভেম্বর ২৬৪ প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ‘প্রাকৃতিক কারণে এবার লবণ উৎপাদন মৌসুম অন্তত ১৫ দিন পরে শুরু হয়েছে। পূর্ব সতর্কতা হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন মৌসুম ধরা হয়। তবে বছরজুড়ে মাঠে উৎপাদিত লবণের দাম বেশি পাওয়া ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কারণে চাষিরা আগাম লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছেন। একই সঙ্গে চাষের পরিধি, লবণ চাষি, মৌজার সংখ্যাও বেড়েছে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ ২৮ হাজার টন, যা গত মৌসুমে ছিল ২৩ লাখ ৮৫ হাজার টন।