গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা মহাসাবেশের পর ৩১ অক্টোবর টানা তিনদিন অবরোধের ডাকদেন তারা যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের সার্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না কোম্পানিগুলো। বন্দর থেকে কাঁচামালও খালাস করতে পারছে না। যার প্রভাব পড়তে পারে উৎপাদনে। পণ্য বিক্রিও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এতে কোম্পানিগুলোর উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
পণ্য সরবরাহকারী বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ তথ্য। দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ জানায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চলমান অবরোধে কোম্পানিটির পণ্য সরবরাহ কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। নিরবচ্ছিন্নভাবে সারাদেশে পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন , ‘রাতে যেখানে যেখানে পারছি পণ্য পাঠাচ্ছি। তবে অনেক জায়গা থেকে পণ্য ফিরে এসেছে। কোথাও পথে আটকা রয়েছে। মার্কেটে সরবরাহ ঠিক রাখতে সমস্যা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ব্যবসা টালমাটাল অবস্থায়। যে কারণে মূল্যস্ফীতির মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ কাটছে। এমন সময় এ হরতাল-অবরোধের কারণে ব্যবসায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।’
সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া ছাড়াও অন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। ছোট থেকে বড়— সব ধরনের ব্যবসায়ীই নাশকতার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বলে জানান। অনেক এলাকায় প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য সরবরাহকারী গাড়িতে হামলা হয়েছে। জানমালের ঝুঁকিতে রয়েছেন কোম্পানিতে কর্মরতরা। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না পরিবহন নাশকতার ভয়ে পণ্য পরিবহনে অনীহা দেখাচ্ছেন পরিবহন মালিকরাও। বন্দর থেকে পণ্য খালাস বিঘ্নিত হচ্ছে অবরোধের প্রথম দিন থেকেই। যে কারণে শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না। যাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পণ্য আমদানিকারক ও বিপণনকারী আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স) শফিউল আতহার তসলিম বলেন, ‘আজ (বুধবার) আমাদের পাঁচ কনটেইনার জরুরি কাঁচামাল খালাস হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা করতে পারিনি। মাত্র একটি খালাস হচ্ছে সন্ধ্যায়।’ তিনি বলেন, ‘বাকি কাঁচামালের জন্য পণ্য উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হবে। পণ্য খালাস না করতে পারায় ডেমারেজও (মাশুল) গুনতে হচ্ছে।’
আকিজ প্লাস্টিকসের হেড অব অপারেশন্স মিনহাজ বিন মিজান বলেন, ‘চাহিদা থাকলেও পরিবেশকদের কাছে পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। অবরোধের প্রথম দিনে কোম্পানির একজন চালক হামলার শিকার হন। আবার কাঁচামাল সংকট হচ্ছে, যার প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণত দেশে হরতাল-অবরোধে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দোকানপাটে বেচাবিক্রি কমে যায়। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য সারাদেশে পৌঁছাতে পারেন না। সে কারণেও বিক্রিতেও ভাটা পড়ে। আবার ক্রেতারাও ঝুঁকি নিয়ে পণ্য কিনতে বের হতে চান না। রপ্তানিপণ্যও ঠিকমতো পাঠানো যায় না। নির্ধারিত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারলে ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকিতে পড়েন উদ্যোক্তারা। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সব পণ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্যের প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
জানা যায়, একদিন হরতাল বা অবরোধে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। হরতাল, অবরোধের মতো অসহিষ্ণু কর্মসূচি চলতে থাকলে বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতি এর ভার সইতে পারবে না।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে। যারা এমন উদ্বেগের রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছেন, সেটা ঠিক নয়। কারণ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে।’
প্রতিটি দলকে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। যে কর্মসূচি অর্থনীতিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেটা আমাদের প্রত্যাশিত নয়।’ মাহবুবুল আলম আরও বলেন, ‘আমরা চাই বিগত কয়েক বছরের মতো শান্তিপূর্ণ ধারায় অন্দোলন হোক। ব্যবসায়ীরা সব সময় শান্তিপূর্ণ অবস্থা আশা করে। তবেই দেশের অর্থনীতির চাকা চাঙা থাকবে।’
বুধবার এফবিসিসিআইয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ ব্যবস্থা) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বাড়ায় ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়েছে।