ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রায় বছর হতে চলল। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে রুশ সৈন্যরা যখন ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে তখন হয়তো অনেকেই ভেবেছিলেন, কিয়েভের পরাজয় বুঝি সময়ের ব্যাপারমাত্র।
তবে গত ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে যেভাবে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে, তাতে ন্যাটো বনাম রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভৌগোলিক দিক থেকে শুরু হলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইউরোপ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত এ সংঘাত বন্ধের কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ইউক্রেনের হয়ে পরোক্ষভাবে লড়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব।
ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের সম্ভাবনায় নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং দেশটিতে রুশ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন অভিযান শুরু করে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে ইউক্রেনের চার অঞ্চল- দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নেয় রুশ বাহিনী। সেসব অঞ্চলে সামরিক আইনও জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
যুদ্ধে সমর্থন আদায়ের জন্য চীন, তুরস্ক ও ইরানের দিকে ঝুঁকছে রাশিয়া। অন্যদিকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক জোট।
সম্প্রতি কিয়েভের চাহিদা অনুযায়ী দেশটিতে অত্যাধুনিক ট্যাংক সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। খুব শিগগিরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০টি আব্রামস ট্যাংক পাঠাবে ইউক্রেনে। জার্মান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪টি লেপার্ড ট্যাংক পাবে কিয়েভ। এছাড়া যুক্তরাজ্য চ্যালেঞ্জার এবং কানাডা থেকে লেপার্ড নামক শক্তিশালী ট্যাংক যাবে ইউক্রেনের জন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কিয়েভে এসব ট্যাংক হস্তান্তর একদিকে যেমন রাশিয়ার বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে, অপরদিকে পশ্চিমা বিশ্ব বা ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোকেও এ যুদ্ধে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর রাশিয়ার বিপক্ষে এমন কঠোর অবস্থান এবং কিয়েভকে দিয়ে আসা এমন সমর্থনের পরিণাম কী হতে পারে?
গত মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দেশটির সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থা রাশিয়ান সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব নিকোলাই পাত্রুশেভ বলেছেন, ইউক্রেনে এখন আর ইউক্রেনীয় বাহিনীর সঙ্গে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে লড়াই করছে রুশ সেনারা।
তিনি বলেন, পশ্চিমাদের পরিকল্পনা হলো, রাশিয়াকে টুকরো টুকরো করে ফেলা এবং বিশ্বের মানচিত্র থেকে রাশিয়া নামটি মুছে ফেলা। এ যুদ্ধকে ঘিরে তারা তাদের সেই অভিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে চাইছে।
এছাড়া ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনোভ বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষকে রাশিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য চাপ দিচ্ছে।
এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছিলেন, ‘ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অংশ’ এবং ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী তাদের অঞ্চল রক্ষার জন্য মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। তার এ বিবৃতি সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে রাশিয়ান কূটনীতিক বলেছিলেন, ‘আমরা বলতে পারি যে, আমেরিকান কর্মকর্তারা বিশেষ করে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এসব বক্তব্যের মাধ্যমে মূলত কিয়েভ সরকারকে রাশিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য উসকানি দিচ্ছে।
ইউক্রেনে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের ইউরেশিয়া সেন্টারের সিনিয়র ডিরেক্টর জন হার্বস্ট বিষয়টি ব্যাখা করেছেন এভাবে – ন্যাটোর সঙ্গে রুশ সেনারা যুদ্ধ করছে এটি প্রচারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে তার দেশের জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। রুশ জনগণকে তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো জড়িয়ে পড়ায় তার দেশ প্রত্যাশা অনুযায়ী সফলতা পায়নি।
হার্বস্ট মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, রুশ বাহিনী ইউক্রেনে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য না পাওয়ায় এটাকে এখন ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ বলে প্রচার করা তাদের জন্য কিছুটা সহায়ক হবে। এছাড়া তারা এ যুদ্ধকে পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত করার হুমকি দিচ্ছে, যদি তা সত্যি পারমাণবিক যুদ্ধে জড়ায় পরবর্তীতে তাদের এ দাবি ন্যায্যতা প্রমাণে সহায়ক হবে।
হার্বস্ট মনে করেন, পশ্চিমের বিরুদ্ধে রাশিয়ার তথ্যযুদ্ধ তার সামরিক অভিযানের চেয়ে বেশি সফল হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে জড়িয়ে পড়ছে ন্যাটো
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত কয়েকটি দেশের ট্যাংক সরবরাহের সঙ্গে দুটি বিষয় জড়িত, যা এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ন্যাটো বনাম রাশিয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে, সেটাকে আরও একধাপ বাড়াতে পারে।
তার মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আব্রামস ট্যাংক ও জার্মানির লেপার্ড জাতীয় ট্যাংকে ব্যবহৃত বিশেষ একধরনের গোলা, যা দিয়ে শত্রুপক্ষের ট্যাংক ও কংক্রিটের বাংকার ধ্বংস করা যায়।
সমর-বিশেষজ্ঞ এবং কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, যদি এ ধরনের গোলা তাদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তাহলে একে পারমাণবিক অস্ত্র-সমতুল্য বলে তারা ধরে নেবেন এবং প্রয়োজনীয় পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন। তার মানে এর মাধ্যমে যুদ্ধের মাত্রা একধাপ ওপরে উঠে যাবে এবং সেটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে
আরেকটি দিক হচ্ছে ন্যাটোর ট্যাংকের পাশাপাশি ইউক্রেনের মাটিতে পশ্চিমা প্রশিক্ষক ও সামরিক উপদেষ্টাদের সম্ভাব্য উপস্থিতি।
মাহমুদ আলি বলেন, তবে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টার উপস্থিতি ২০১৪ সাল থেকেই ছিল। উত্তর ইউক্রেনে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ওপর রাশিয়া আক্রমণও চালিয়েছিল, যাতে বেশকিছু লোক হতাহত হয়। তবে এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা
ইউক্রেনকে ন্যাটো ট্যাংক দিলে উত্তেজনা বেড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে বা রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে – এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেক বিশ্লেষকই। এখন এর সঙ্গে যুদ্ধবিমান যোগ হলে কী হতে পারে!
ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, ন্যাটো কখনোই চাইবে না রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে, যা হবে ‘ভয়াবহ বিপজ্জনক’। তাই সেটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দুপক্ষই চেষ্টা করবে।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি কয়েকবারই দিয়েছে; কিন্তু তেমন কিছু করেনি। ফলে পশ্চিমা নেতারা সম্ভবত একে তেমন বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন না; কিন্তু এ ধরনের একটা হুমকি তো রয়েই গেছে।
রুশ বিশ্লেষক স্টিফেন ডিয়েল বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের চিন্তা একেবারে বাদ দেয়া যায় না, তবে রাশিয়া ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে – এমন সম্ভাবনা এক বছর আগের তুলনায় কমে গেছে।
তিনি বলেন, রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি দিচ্ছে ঠিকই; কিন্তু এটা হয়তো একটা ধাপ্পাবাজি। কারণ তারা ভালো করেই জানে ইউক্রেনে একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে পশ্চিমা বিশ্বও পাল্টা আঘাত করতে পারে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন