স্টাফ রিপোর্টারঃ সংক্রমণের ঝুঁকি জেনেও জীবনবাজি রেখে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় দিন-রাত কাজ করছি। অথচ আমাদের দুপুরে ও রাতে খেতে দেয়া হচ্ছে সাধারণ মানের খাবার। ভাত, ডিম আর ডাল! উন্নতমানের আবাসিক হোটেলে থাকা এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে দেয়ার প্রতিশ্রুতি কি তাহলে মিথ্যা?’
‘দশতলার ওপর ডাইনিংয়ে দলবেঁধে খেতে যাওয়ার কারণে কি সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে না। মিডিয়ার কাছে এগুলো বলাও নিষেধ। কর্তৃপক্ষের এ কেমন আচরণ… কষ্টের কথাও বলা যাবে না।’
শনিবার দুপুরের খাবার খেতে বসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড সরকারি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কয়েকজন নার্স।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘রোগীর সেবা দিতে তারা যতটা না ক্লান্ত, তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত হচ্ছেন ডিউটি শেষে ঘুমানোর ভালো জায়গা এবং প্রোটিন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার না পেয়ে।’
তারা আরও বলেন, “সপ্তাহখানেক আগে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তাদের এখনও হাসপাতালের ফাঁকা ওয়ার্ডে, ডরমেটরির ফ্লোরে, ড্রেস চেঞ্জ ও ওটি কক্ষে রাত্রিযাপন করতে হচ্ছে। এ নিয়ে হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্টকে অবহিত করা হলো ‘এই তো হয়ে যাচ্ছে’ বলে সময়ক্ষেপণ করছেন।”
কুর্মিটোলা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড ও আইসিইউতে কর্তব্যরত এবং বর্তমানে হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইনে থাকা কয়েকজন নার্স জানান, করোনা রোগীদের ক্লোজ কন্ট্রাক্টে এসে কাজ করতে হয় বলে কর্তব্যরত নার্সরা এমনিতেই মানসিক চাপে থাকেন।
ডিউটি শেষ করে ক্লান্ত দেহে ক্ষুধায় পেট যখন জ্বলে তখন তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়া হয় না। তাদের দশতলার ডাইনিং হলে গিয়ে সবার সঙ্গে বসে খেতে হয়।
এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা যে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বলেন তা মানা হয় না। তারা জানেন না, তাদের মধ্যেই কেউ করোনাভাইরাস বহন করছেন কি-না, ওই সহকর্মীর মাধ্যমে কেউ সংক্রমিত হচ্ছেন কি-না?
শুধু কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল নয়, রাজধানীর উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের চিত্রও একই। সেখানেও ভালো নেই নার্সরা।
জীবনবাজি রেখে ভয়াবহ ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় দিন-রাত নিয়োজিত থাকলেও প্রতিটি মুহূর্ত সংক্রমিত হওয়ার অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে তাদের।
হাড়ভাঙা খাটুনির পর নার্সদের সুষম খাদ্যগ্রহণ অত্যাবশ্যক হলেও তাদের ভাগ্যে জুটছে স্থানীয় একটি হোটেলের রান্না করা নিম্নমানের খাবার। গত ১২ এপ্রিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের না খেয়ে কাটানোর খবরও প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় সব মহলে।
গত ১৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, মুখ্য সমন্বয়ক, সচিব এবং অন্যান্য দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের সরকারি হাসপাতালে রোগীদের খাবার ১২৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা এবং এ নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়।
করোনা চিকিৎসার সাথে জড়িত চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ আরও বেশি নির্ধারণের কথাও উঠে আসে। কিন্তু তিনদিন পার হলেও আগের মতোই রোগীদের একই ধরনের খাবার (সকালে রুটি, ডিমসিদ্ধ, কলা; দুপুরে ফার্মের মুরগির এক টুকরা মাংস/ডিম ও ডালসহ ভাত এবং রাতে দুপুরের মতো একই ধরনের খাবার) খেতে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর রাজধানী ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মহাখালী শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, উত্তরা কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, লালকুঠি বাজার
মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বাবুবাজার মহানগর জেনারেল হাসপাতাল ও কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালকে ডেডিকেটেড করে এসব হাসপাতালে চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা ও খাওয়ার জন্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর গত ১২ এপ্রিল রাজধানীর ১৯টি হোটেল নির্বাচিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য রিজেন্সি হোটেল বরাদ্দ হলেও এখনও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসানের মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।