ঢাকা ১১:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বনবি (সা.) মেরাজ ও এর দর্শন

MERAZ

ধর্ম ডেস্ক,   ( মাহমুদ আহমদ ): ইসলামিক গবেষক ও কলামিস্টঃ  ইসলামে মেরাজের গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবির (সা.) রুহকে স্বয়ং আল্লাহপাক পবিত্র করেছিলেন, ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে স্বর্গারোহণে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহানবির (সা.) মেরাজ নিয়ে উম্মতে মুহাম্মদিয়ার মাঝে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।

কেউ মনে করেন বিশ্বনবির (সা.) মেরাজ বোরাকযোগে মসজিদুল হারাম, বাইতুল্লাহ থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা সশরীরে ভ্রমণ করে সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য অর্জন এবং তার সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন।

অপর একশ্রেণির বিশ্বাস, এ ঘটনা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) এই সফর দৈহিক ছিল না আধ্যাত্মিক? এ বিষয়ে আমাদের কুরআন খুলে দেখতে হবে যে, এতে কি উল্লেখ রয়েছে।

এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, ‘তিনি পরম পবিত্র ও মহিমায়, যিনি রাত্রিযোগে আপন বান্দাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানিত মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (দূরবর্তী মসজিদ) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, যার চারদিকে আমি বরকত মÐিত করেছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’।

এ আয়াতে মহানবির (সা.) এক কাশফ বা দিব্য দর্শন, যা রাত্রিকালীন আধ্যাত্মিক সফর সম্পর্কে ব্যক্ত হয়েছে, যা অধিকাংশ তফসিরকারকের মতে মেরাজ বা আধ্যাত্মিক স্বর্গারোহণ বলে পরিচিত।

এখানে মক্কা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত মহানবির (সা.) ইসরা (রাত্রিতে ভ্রমণ) আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, এটি মহানবির (সা.) নবুয়তের একাদশ বছরে সংঘটিত হয়েছিল আর কোনো কোনো খ্রিষ্টান লেখকের মতে তা নবুয়তের দশম বছরে ঘটেছে। ইবনে সা’আদ এবং মারদাওয়াইয়ের মতে, হিজরতের এক বছর আগে রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখ এ ঘটনা ঘটেছে (আল খাসাইসুল কুবরা)। বায়হাকিও বর্ণনা করেছেন এটি হিজরতের এক বছর বা ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়েছিল।

বিভিন্ন বর্ণনা মতে, এটাই স্পষ্ট হয় নবুয়তের দ্বাদশ বছরে হিজরতের এক বছর বা ছয় মাস আগে ইসরার ঘটনা ঘটেছিল। হজরত খাদিজার (রা.) মৃত্যুর পর হজরত মহানবি (সা.) তখন তার চাচাতো বোন হজরত উম্মে হানির (রা.) ঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু অধিকাংশ পন্ডিতের মতে, মেরাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের পঞ্চম বছরে।

এতে দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ের মধ্যেও ৬-৭ বছরের ব্যবধান রয়েছে। কাজেই মেরাজ ও ইসরা এ ঘটনা দুটি ভিন্ন ভিন্ন, একটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এছাড়া ওই সব ঘটনা যা মহানবির (সা.) মেরাজের ঘটনা বলে হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে তা ইসরার ঘটনাবলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।

মেরাজ ও ইসরা মূলত দুটি পৃথক বিষয়। উভয় ঘটনা আধ্যাত্মিক বিস্ময়কর ব্যাপার। আসলে পবিত্র কুরআন-হাদিস দ্বারা যা প্রমাণিত হয় তা হলো মহানবি (সা.) সশরীরে ঊর্ধ্বগমনও করেননি আর সশরীরে জেরুজালেমও গমন করেননি। পবিত্র কুরআনের সুরা আন নাজমে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মেরাজ সম্বন্ধে বর্ণনা দেয়া হয়েছে কিন্তু ইসরা সম্পর্কে কোনো পরোক্ষ আয়াত পর্যন্ত নেই। ইসরা সংঘটিত হওয়ার রাতে মহানবি (সা.) তার চাচাতো বোন উম্মে হানীর (রা.) ঘরে ছিলেন এবং তাকে তিনি (সা.) শুধু তার জেরুজালেম সফরের কথাই বলেছেন, জান্নাত সফরের কোনো কথাই বলেননি।

তিনি (সা.) যদি হজরত উম্মে হানীকে (রা.) কিছু বলতেন তাহলে তিনি (রা.) তার একাধিক বর্ণনার কোনো একটিতে অন্তত এ বিষয়ে উল্লেখ না করে পারতেন না। কিন্তু তিনি (রা.) তার কোনো বর্ণনায় এ কথা উল্লেখ না করায় এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় মহানবি (সা.) যে রাত্রিতে জেরুজালেমে আধ্যাত্মিক সফর করেছিলেন সে রাত্রিতে মেরাজ সংঘটিত হয়নি।

সুরা নাজম ও সুরা বনিইসরাইল থেকে যা জানা যায়, তাহল মহানবির (সা.) ইসরা নামক একটি আধ্যাত্মিক সফর হয়েছে আর মেরাজ নামে আরেকটি আধ্যাত্মিক সফর হয়েছে। মহানবির (সা.) পবিত্র জীবনে মেরাজ শুধু একবারই যে ঘটেছে তাও ঠিক নয়, কারণ ছিনাচাকের যে ঘটনা তা তার শৈশবেই ঘটেছিল, যখন তিনি (সা.) ছাগল চড়াচ্ছিলেন। বিষয়টা স্পষ্ট যে, মেরাজ কোন এক ঘটনার নাম নয়।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মহানবির (সা.) মেরাজ অনেকবারই হয়েছে। এছাড়া মহানবি (সা.) এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, মুমিনের মেরাজ হয় নামাজের মাধ্যমে। অর্থাৎ মুমিন মুত্তাকিরাও আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারেন নামাজের মাধ্যমে। এ রাস্তা এখনও খোলা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত খোলা থাকবে।

মহানবির (সা.) মেরাজ যদি দৈহিক হয়ে থাকে তাহলে পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াত মিথ্যা প্রমাণিত হয়, নাউজুবিল্লাহ। পবিত্র কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহপাক যেভাবে নাজিল করেছেন এর একটি জের, জবর পরিবর্তন করার ক্ষমতাও যেমন কারো নেই, তেমনি আল্লাহর কোনো আয়াত ভুল হতে পারে না।

সশরীরে আকাশে যাওয়া পবিত্র কুরআনের শিক্ষার পরিপন্থী:

যেমন মক্কার মুশরিকরা যখন মহানবির (সা.) কাছে দাবি উত্থাপন করে বললেন, তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাক তাহলে আমাদের জন্য ভূমি থেকে প্রস্রবণ প্রবাহিত কর অথবা খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করো, আর আমাদের ওপর আকাশ টুকরা টুকরা করে ফেল অথবা আল্লাহ এবং ফেরেশতাদের আমাদের সামনাসামনি এনে খাড়া করো। অথবা তোমার জন্য স্বর্ণ নির্মিত কোনো ঘর হয় অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করো এবং আমরা তোমার আকাশ আরোহণ কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আমাদের ওপর কোনো কিতাব নাজেল কর, যা আমরা পাঠ করতে পারি। কাফেরদের এসব আপত্তির উত্তরে আল্লাহ তাআলা মহানবিকে (সা.) বলেছিলেন, তুমি বল আমার প্রতিপালক পবিত্র, আমি কেবল একজন মানব রসুল। (সুরা বনিইসরাইল: আয়াত ৯০-৯৩)।

একটু ভেবে দেখুন! তাদের যা দাবি ছিল তা মানবীয় শক্তির অসাধ্য এবং আল্লাহ তাআলার নবী প্রেরণের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। হ্যাঁ, আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন, কথাটা একান্তই সত্য কিন্তু আল্লাহ তার বিধানের বাইরে কিছুই করেন না। আল্লাহর বিধানে এটা নেই যে, কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ সশরীরে আকাশে উঠে যাবেন। যেটা আল্লাহর বিধান পরিপন্থী কাজ তা তিনি কীভাবে করতে পারেন?

এছাড়া সুরা বনি ইসরাইলের ৯৩ আয়াতে মহানবির (সা.) দৈহিকভাবে ঊর্ধ্ব আকাশে গমন অসম্ভব বলে আল্লাহ তাআলাই জানিয়েছেন, তাহলে কীভাবে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, মহানবির (সা.) মেরাজ দৈহিকভাবে হয়েছিল? আর মেরাজের ঘটনা যদি দৈহিকভাবেই ঘটে থাকত তাহলে কাফেররা মহানবিকে (সা.) অবশ্যই বলত, তুমি না সশরীরে সব আকাশ ঘুরে এসেছ, এখন তাহলে কেন বলছ এটা মানব রসুলের পক্ষে সম্ভব না?

শ্রেষ্ঠ নবীর (সা.) মেরাজ নিয়ে মতভেদ না করে আমরা যদি এটিকে আধ্যাত্মিক মনে করি, তাতে কিন্তু কুরআনের সত্যতা এবং বিশ্বনবীর (সা.) শ্রেষ্ঠত্ব আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কেননা, পবিত্র কুরআন যেখানে বলছে মানব রসুলের পক্ষে আকাশে আরোহণ করা সম্ভব নয়। তাই যা পবিত্র কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয় তা গ্রহণ ও বিশ্বাস করতে হবে আর এর মাধ্যমেই আমাদের কল্যাণ নিহিত। এছাড়া মুসলিম বিশ্ব যদি পবিত্র কুরআনের শিক্ষানুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করে তাহলে বিশ্ব মুসলিমের মাঝেও ঐক্য ফিরে আসবে এবং বিশ্বময় হবে শান্তিময়।

আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনাই করি, তিনি যেন আমাদের আত্মাকে শান্তিময় করেন আর ইহ জীবনেই যেন লাভ করতে পারি আল্লাহপাকের জান্নাতের স্বাদ। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট আর এই পর্যায়ে যখন মুমিনের আত্মা উপনিত হয়, তখনই আল্লাহপাক তাকে মেরাজের মর্যাদায় ভূষিত করেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

ট্যাগস
সর্বাধিক পঠিত

বিশ্বনবি (সা.) মেরাজ ও এর দর্শন

আপডেট সময় ০৭:০৮:১২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ মার্চ ২০২০

ধর্ম ডেস্ক,   ( মাহমুদ আহমদ ): ইসলামিক গবেষক ও কলামিস্টঃ  ইসলামে মেরাজের গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবির (সা.) রুহকে স্বয়ং আল্লাহপাক পবিত্র করেছিলেন, ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে স্বর্গারোহণে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহানবির (সা.) মেরাজ নিয়ে উম্মতে মুহাম্মদিয়ার মাঝে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।

কেউ মনে করেন বিশ্বনবির (সা.) মেরাজ বোরাকযোগে মসজিদুল হারাম, বাইতুল্লাহ থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা সশরীরে ভ্রমণ করে সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য অর্জন এবং তার সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন।

অপর একশ্রেণির বিশ্বাস, এ ঘটনা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) এই সফর দৈহিক ছিল না আধ্যাত্মিক? এ বিষয়ে আমাদের কুরআন খুলে দেখতে হবে যে, এতে কি উল্লেখ রয়েছে।

এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, ‘তিনি পরম পবিত্র ও মহিমায়, যিনি রাত্রিযোগে আপন বান্দাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানিত মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (দূরবর্তী মসজিদ) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, যার চারদিকে আমি বরকত মÐিত করেছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’।

এ আয়াতে মহানবির (সা.) এক কাশফ বা দিব্য দর্শন, যা রাত্রিকালীন আধ্যাত্মিক সফর সম্পর্কে ব্যক্ত হয়েছে, যা অধিকাংশ তফসিরকারকের মতে মেরাজ বা আধ্যাত্মিক স্বর্গারোহণ বলে পরিচিত।

এখানে মক্কা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত মহানবির (সা.) ইসরা (রাত্রিতে ভ্রমণ) আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, এটি মহানবির (সা.) নবুয়তের একাদশ বছরে সংঘটিত হয়েছিল আর কোনো কোনো খ্রিষ্টান লেখকের মতে তা নবুয়তের দশম বছরে ঘটেছে। ইবনে সা’আদ এবং মারদাওয়াইয়ের মতে, হিজরতের এক বছর আগে রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখ এ ঘটনা ঘটেছে (আল খাসাইসুল কুবরা)। বায়হাকিও বর্ণনা করেছেন এটি হিজরতের এক বছর বা ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়েছিল।

বিভিন্ন বর্ণনা মতে, এটাই স্পষ্ট হয় নবুয়তের দ্বাদশ বছরে হিজরতের এক বছর বা ছয় মাস আগে ইসরার ঘটনা ঘটেছিল। হজরত খাদিজার (রা.) মৃত্যুর পর হজরত মহানবি (সা.) তখন তার চাচাতো বোন হজরত উম্মে হানির (রা.) ঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু অধিকাংশ পন্ডিতের মতে, মেরাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের পঞ্চম বছরে।

এতে দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ের মধ্যেও ৬-৭ বছরের ব্যবধান রয়েছে। কাজেই মেরাজ ও ইসরা এ ঘটনা দুটি ভিন্ন ভিন্ন, একটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এছাড়া ওই সব ঘটনা যা মহানবির (সা.) মেরাজের ঘটনা বলে হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে তা ইসরার ঘটনাবলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।

মেরাজ ও ইসরা মূলত দুটি পৃথক বিষয়। উভয় ঘটনা আধ্যাত্মিক বিস্ময়কর ব্যাপার। আসলে পবিত্র কুরআন-হাদিস দ্বারা যা প্রমাণিত হয় তা হলো মহানবি (সা.) সশরীরে ঊর্ধ্বগমনও করেননি আর সশরীরে জেরুজালেমও গমন করেননি। পবিত্র কুরআনের সুরা আন নাজমে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মেরাজ সম্বন্ধে বর্ণনা দেয়া হয়েছে কিন্তু ইসরা সম্পর্কে কোনো পরোক্ষ আয়াত পর্যন্ত নেই। ইসরা সংঘটিত হওয়ার রাতে মহানবি (সা.) তার চাচাতো বোন উম্মে হানীর (রা.) ঘরে ছিলেন এবং তাকে তিনি (সা.) শুধু তার জেরুজালেম সফরের কথাই বলেছেন, জান্নাত সফরের কোনো কথাই বলেননি।

তিনি (সা.) যদি হজরত উম্মে হানীকে (রা.) কিছু বলতেন তাহলে তিনি (রা.) তার একাধিক বর্ণনার কোনো একটিতে অন্তত এ বিষয়ে উল্লেখ না করে পারতেন না। কিন্তু তিনি (রা.) তার কোনো বর্ণনায় এ কথা উল্লেখ না করায় এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় মহানবি (সা.) যে রাত্রিতে জেরুজালেমে আধ্যাত্মিক সফর করেছিলেন সে রাত্রিতে মেরাজ সংঘটিত হয়নি।

সুরা নাজম ও সুরা বনিইসরাইল থেকে যা জানা যায়, তাহল মহানবির (সা.) ইসরা নামক একটি আধ্যাত্মিক সফর হয়েছে আর মেরাজ নামে আরেকটি আধ্যাত্মিক সফর হয়েছে। মহানবির (সা.) পবিত্র জীবনে মেরাজ শুধু একবারই যে ঘটেছে তাও ঠিক নয়, কারণ ছিনাচাকের যে ঘটনা তা তার শৈশবেই ঘটেছিল, যখন তিনি (সা.) ছাগল চড়াচ্ছিলেন। বিষয়টা স্পষ্ট যে, মেরাজ কোন এক ঘটনার নাম নয়।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মহানবির (সা.) মেরাজ অনেকবারই হয়েছে। এছাড়া মহানবি (সা.) এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, মুমিনের মেরাজ হয় নামাজের মাধ্যমে। অর্থাৎ মুমিন মুত্তাকিরাও আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারেন নামাজের মাধ্যমে। এ রাস্তা এখনও খোলা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত খোলা থাকবে।

মহানবির (সা.) মেরাজ যদি দৈহিক হয়ে থাকে তাহলে পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াত মিথ্যা প্রমাণিত হয়, নাউজুবিল্লাহ। পবিত্র কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহপাক যেভাবে নাজিল করেছেন এর একটি জের, জবর পরিবর্তন করার ক্ষমতাও যেমন কারো নেই, তেমনি আল্লাহর কোনো আয়াত ভুল হতে পারে না।

সশরীরে আকাশে যাওয়া পবিত্র কুরআনের শিক্ষার পরিপন্থী:

যেমন মক্কার মুশরিকরা যখন মহানবির (সা.) কাছে দাবি উত্থাপন করে বললেন, তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাক তাহলে আমাদের জন্য ভূমি থেকে প্রস্রবণ প্রবাহিত কর অথবা খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করো, আর আমাদের ওপর আকাশ টুকরা টুকরা করে ফেল অথবা আল্লাহ এবং ফেরেশতাদের আমাদের সামনাসামনি এনে খাড়া করো। অথবা তোমার জন্য স্বর্ণ নির্মিত কোনো ঘর হয় অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করো এবং আমরা তোমার আকাশ আরোহণ কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আমাদের ওপর কোনো কিতাব নাজেল কর, যা আমরা পাঠ করতে পারি। কাফেরদের এসব আপত্তির উত্তরে আল্লাহ তাআলা মহানবিকে (সা.) বলেছিলেন, তুমি বল আমার প্রতিপালক পবিত্র, আমি কেবল একজন মানব রসুল। (সুরা বনিইসরাইল: আয়াত ৯০-৯৩)।

একটু ভেবে দেখুন! তাদের যা দাবি ছিল তা মানবীয় শক্তির অসাধ্য এবং আল্লাহ তাআলার নবী প্রেরণের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। হ্যাঁ, আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন, কথাটা একান্তই সত্য কিন্তু আল্লাহ তার বিধানের বাইরে কিছুই করেন না। আল্লাহর বিধানে এটা নেই যে, কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ সশরীরে আকাশে উঠে যাবেন। যেটা আল্লাহর বিধান পরিপন্থী কাজ তা তিনি কীভাবে করতে পারেন?

এছাড়া সুরা বনি ইসরাইলের ৯৩ আয়াতে মহানবির (সা.) দৈহিকভাবে ঊর্ধ্ব আকাশে গমন অসম্ভব বলে আল্লাহ তাআলাই জানিয়েছেন, তাহলে কীভাবে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, মহানবির (সা.) মেরাজ দৈহিকভাবে হয়েছিল? আর মেরাজের ঘটনা যদি দৈহিকভাবেই ঘটে থাকত তাহলে কাফেররা মহানবিকে (সা.) অবশ্যই বলত, তুমি না সশরীরে সব আকাশ ঘুরে এসেছ, এখন তাহলে কেন বলছ এটা মানব রসুলের পক্ষে সম্ভব না?

শ্রেষ্ঠ নবীর (সা.) মেরাজ নিয়ে মতভেদ না করে আমরা যদি এটিকে আধ্যাত্মিক মনে করি, তাতে কিন্তু কুরআনের সত্যতা এবং বিশ্বনবীর (সা.) শ্রেষ্ঠত্ব আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কেননা, পবিত্র কুরআন যেখানে বলছে মানব রসুলের পক্ষে আকাশে আরোহণ করা সম্ভব নয়। তাই যা পবিত্র কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয় তা গ্রহণ ও বিশ্বাস করতে হবে আর এর মাধ্যমেই আমাদের কল্যাণ নিহিত। এছাড়া মুসলিম বিশ্ব যদি পবিত্র কুরআনের শিক্ষানুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করে তাহলে বিশ্ব মুসলিমের মাঝেও ঐক্য ফিরে আসবে এবং বিশ্বময় হবে শান্তিময়।

আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনাই করি, তিনি যেন আমাদের আত্মাকে শান্তিময় করেন আর ইহ জীবনেই যেন লাভ করতে পারি আল্লাহপাকের জান্নাতের স্বাদ। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট আর এই পর্যায়ে যখন মুমিনের আত্মা উপনিত হয়, তখনই আল্লাহপাক তাকে মেরাজের মর্যাদায় ভূষিত করেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।