স্টাফ রিপোর্টার নওগাঁ: রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পেরিয়েছে ৬৯ বছর। অথচ নওগাঁর এক তৃতীয়াংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার। এতে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস, গুরুত্ব ও ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১১টি উপজেলায় এক হাজার ৩৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এরমধ্যে শহীদ মিনার আছে মাত্র ২০৩টিতে। শহীদ মিনার নেই- নওগাঁ সদরে ১২৪টি, বদলগাছী ১০৩টি, মহাদেবপুর ৯৫টি, মান্দা ১২৮টি, নিয়ামতপুর ১২৫টি, পোরশা ৮৭টি, সাপাহার ৯৩টি, পত্নীতলায় ১৩১টি, ধামইরহাট ৭৮টি, রানীনগর ৮৬টি এবং আত্রাইয়ে ১২১টি বিদ্যালয়ে।
অপরদিকে জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি মোট ৯২৫টি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ৪৫৫টিতে শহীদ মিনার নেই। যার অধিকাংশ মাদরাসা।
শিক্ষার মানোয়ন্ননে সরকার প্রতি বছরই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও ভবনসহ অবকাঠামো তৈরিতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণে কোনো বরাদ্দ দেয়া হয় না।
ভাষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ সেসব ভাষা শহীদদের স্মরণ করার জন্য নেই শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের নাম পাঠ্যপুস্তকের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। শহীদ মিনার না থাকায় ভাষা শহীদদের স্মরণ ও শ্রদ্ধায় ফুল নিবেদন থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা।
তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নিজেদের উদ্যোগে কলাগাছ পুঁতে, বাঁশ, কাঠ, কাদামাটি ও কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পেলেও এর ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা নেয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাম পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকা আবশ্যক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নওগাঁ সদর উপজেলার দোগাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৮৮৯ সালে, পিরোজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৪২ সালে এবং মান্দা উপজেলার শ্রীরামপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও নেই শহীদ মিনার।
পিরোজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, পাঠ্য বইয়ে শহীদ মিনার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেয়া হয়ে থাকে। ২১শে ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে কাদামাটি দিয়ে অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
প্রতি বছরই বিদ্যালয়ের ছোটখাটো সংস্কারের ব্যাপারে বরাদ্দ আসে। কিন্তু শহীদ মিনার নির্মাণে কোনো বরাদ্দ আসে না। তাই ইচ্ছা থাকলেও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না বলে জানান তিনি।
বিদ্যালয়ের সভাপতি বিশ্বেস্বর সরকার বলেন, প্রতিটি বিদ্যালয়েই শহীদ মিনার থাকা উচিত। আমাদের বিদ্যালয়ে দীর্ঘ বছর থেকে কোনো শহীদ মিনার নেই। এছাড়া শহীদ মিনার নির্মাণে কোনো ধরনের বরাদ্দ আসে না। বিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো ফান্ডও নেই। ইতোপূর্বে শহীদ মিনার নির্মাণে আলোচনাও হয়েছে।
দোগাছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিউলি ফেরদৌসি আক্তার বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারির আগের দিন শিক্ষার্থীরা কাদামাটি ও ইট দিয়ে অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে। সকাল সকাল বাচ্চারা স্কুলে আসে। তাদের সঙ্গে আমরাও শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তবে স্থায়ীভাবে একটা শহীদ মিনারের প্রয়োজন।
নওগাঁ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গোলাম সামদানি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নির্মাণ করা উচিত। এতে নতুন প্রজন্মরা বুঝতে পারবে প্রতীকটা কিসের এবং এর গুরত্ব কী? শহীদ মিনার দেখে তারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাবে।
নওগাঁ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম বলেন, ভাষার জন্য যে দুইটি দেশ প্রাণ দিয়েছে তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ।
সরকার থেকে বরাদ্দ দিয়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরি করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকে শিশুদের মুখস্থ বিদ্যা না শিখিয়ে যদি সরাসরি শহীদ মিনার দেখিয়ে ধারণা দেয়া হয় তাদের সুপ্ত মেধা দ্রুত বিকাশ পাবে।
নওগাঁ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দীক মোহাম্মদ ইউসুফ রেজা বলেন, সরকার থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো বরাদ্দ দেয়া হয় না। তবে স্থানীয়ভাবে বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার তৈরি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে নিজস্ব উদ্বৃত্ত অর্থ থাকতে হবে।
তিনি বলেন, বই থেকে শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের বিষয়ে ধারণা পেয়ে থাকে। তবে স্বচক্ষে তারা দর্শন করতে পারছে না। বাস্তবে থাকলে তাদের কাছে গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। উপর মহলে এ ব্যাপারে অবগত করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী শহীদ মিনার নির্মাণে একটা বরাদ্দ আসবে।