এবার ইলিশের যে দাম, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ—এমন হিসাবই দিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)। যদিও সংগঠনটি শুধু ঢাকার বাজারের দাম দেখে; তবে সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবেও এবার ইলিশের দাম ছিল সর্বোচ্চ।
মৎস্য অধিদপ্তর অবশ্য প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে তাদের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে। দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, এবারও ইলিশ কম হয়নি। সাগর থেকে ইলিশ ধরতে নৌকা, জ্বালানি তেল, মজুরি—সবই বেড়েছে। তাই দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নদী, সাগর—সবখানে এবার ইলিশ মিলেছে কম। এবার ইলিশের সময়ে, বিশেষ করে জুলাই ও আগস্ট মাসে অস্বাভাবিক কম বৃষ্টিকে দায়ী করছেন গবেষকেরা। অবশ্য কারণ যা-ই হোক, এবার ইলিশের দাম যে চড়া, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই।
ইলিশের উৎপাদন, বাজার, আবহাওয়া, দাম—এসব নিয়ে নানা কথার মধ্যে গত বুধবার মধ্যরাত থেকে বন্ধ হয়ে গেছে ইলিশ ধরা, পরিবহন, মজুত ও বিক্রি। এ নিষেধাজ্ঞা চলবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ ২২ দিন। দেশে পণ্যের দামের পর্যবেক্ষণ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তাদের ওয়েবসাইটের ‘পণ্যভিত্তিক বাজারদর’-এ গিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। তবে দ্রব্যমূল্যের লেখচিত্র প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ইলিশের গড় মূল্য ছিল ১ হাজার ১৫০ টাকা। এটি গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত বছর গড় মূল্য ছিল ১ হাজার ৫০ টাকা।
অন্যদিকে, ক্যাবের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর এক থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। গত বছর দাম বেড়েছিল ১০ থেকে ১২ শতাংশ। ঢাকার বাজারে এবার ইলিশের দাম এক দশক বা ১০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ক্যাবের হিসাব অনুযায়ী, গত মাসে (সেপ্টেম্বর) ঢাকায় ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির ওজনের ইলিশের গড় দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। আর ১ থেকে ২ কেজি ওজনের ইলিশের দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা। গতবারের চেয়ে ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪০০ টাকা। আর ১ থেকে ২ কেজির ওজনের ইলিশের দাম এবার বেড়েছে প্রায় ৩০০ টাকা।
ইলিশের দাম এবার যে বেশি, তা স্বীকার করেন আড়তদার, ব্যবসায়ী, গবেষক, এমনকি মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। বিভিন্ন বন্দরের আড়তদারেরা বলছেন, এবার ইলিশ ধরা পড়েছে অনেক কম। বাজারে পণ্যে সরবরাহ কম হলেই দাম বাড়ে—অর্থনীতির এই সহজ সূত্রই এবার ইলিশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে মনে করেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। যদিও মাছ কম—এমন কথা মানতে নারাজ গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা।
সরকারি হিসাবে, গত বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ মেট্রিক টন। এবারও তার কাছাকাছি উৎপাদন থাকতে পারে বলে মনে করেন ইলিশ-গবেষক আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, প্রতিবছর এ সময়ে ইলিশ কম উৎপাদিত হয়েছে বলে শোনা যায়। এবার এটা বেশি বলা হচ্ছে। এবার দেখা গেছে, একবারে ৩৯ লাখ টাকার ইলিশও পেয়েছেন কেউ কেউ। এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। সেই মাসে এবার ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। আগস্টেও বৃষ্টি খুব বেশি হয়নি। এ দুই মাসে কম বৃষ্টি হওয়ার কারণে ইলিশের উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন আনিছুর রহমান। এই ইলিশ-গবেষকের কথা, ইলিশ ঝাঁক ধরে থাকে। তাই যদি কক্সবাজার অঞ্চলে ইলিশ বেশি পাওয়া যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই পটুয়াখালীতে কম পাওয়া যাবে। এটাই স্বাভাবিক। সব অঞ্চলের হিসাব মিলিয়ে বছর শেষে দেখা যাবে, ইলিশ আগের বছরের মতোই হয়েছে বা এর বেশিও হতে পারে।
ইলিশের ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। মহিপুর বন্দর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিদার উদ্দিন বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার ইলিশ অন্তত ৪০ শতাংশ কম। ইলিশ প্রকৃতির দেওয়া জিনিস, এটা কম হয়েছে কি না, তা জানি না। শুধু জানি, এবার জেলেরা ইলিশ পেয়েছেন অনেক কম।’
ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ক্যাবের বিশ্লেষণ হলো, এবার ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম অত্যধিক করে তুলেছেন। ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজির হোসেন বলেন, ইলিশের মৌসুম শুরুর আগে থেকে দাদন দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। এবার দাম এত বাড়লেও প্রকৃত জেলে সুবিধা পেয়েছেন, এর কোনো নজির নেই। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন। আর বাজারের ওপর সরকারি সংস্থার নজরদারি কম থাকায় দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে।