যশোর প্রতিনিধি: দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল। প্রতি বছর দেশের সিংহভাগ শিল্প কলকারখানা ও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ৩০ হাজার কোটি টাকার মালামাল আমদানি-রফতানি হয় এ বন্দর দিয়ে। একই সঙ্গে ৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। এরই মধ্যে বন্দরটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
এছাড়া চার দেশীয় ট্রানজিট করিডোর বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর। প্রতিদিন এ পথে ৮-১০ হাজার পাসপোর্টযাত্রী ভারত-বাংলাদেশ যাতায়াত করে থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বেনাপোল বন্দরে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা না থাকায় ভারতীয় এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ হাজার ট্রাক মালামাল বোঝাই অবস্থায় এক মাসের বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকে।
ওই ট্রাকের মধ্যে দৈনিক ৬০০-৭০০ ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করার কথা থাকলেও দৈনিক মাত্র ২৫০-৩০০ ট্রাক বেনাপোল বন্দরে আসতে পারে। বাকি ট্রাক আসতে না পারায় আমদানিকারকদের প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার রুপি ডেমারেজ দিতে হয়।
অন্যদিকে বেনাপোল বন্দরে পণ্য রাখার গুদামে জায়গা সংকট আছে। ফলে ভারত থেকে আসা ট্রাকগুলো পণ্য খালাসের অপেক্ষায় টার্মিনালেই ৮-১০ দিন দাঁড়িয়ে থাকছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেনাপোল বন্দরের জন্য ১৫০০ কোটি টাকার ১৭৫ একর জমি (নতুন শেড, কন্টেইনার টার্মিনাল, হেভি স্টক ইয়ার্ড নির্মাণে জন্য) অধিগ্রহণের বিষয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে এ প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সবুজ পাতা ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৭৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ হলে এ বন্দর থেকে কাস্টমসের প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকা এবং বন্দরের ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ সম্ভব বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
বেনাপোল বন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, এ স্থলবন্দরের ৩৪টি গুদাম ও আটটি ইয়ার্ড, দুটি ট্রাক টার্মিনাল ও একটি রপ্তানি টার্মিনাল আছে। কোথাও কোনো জায়গা খালি নেই। তীব্র পণ্যজট চলছে। বর্তমানে বন্দরের গুদামের ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পণ্য আমদানি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, বেনাপোল স্থলবন্দরে যে শেডগুলো আছে সেখানে মালামাল রাখার ধারণ ক্ষমতা বাস্তবে ৫৯ হাজার টন। কিন্তু বর্তমানে দুই লাখ টন মালামাল হ্যান্ডলিং হয়। ফলে ভারত থেকে যে ট্রাকগুলো আসে তা বন্দরে ৮-১০ দিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বেনাপোল স্থলবন্দরে ১৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ পূর্বক সেখানে কমপক্ষে ৩০টি নতুন শেড, হেভি স্টক ইয়ার্ড, কোল্ড স্টোর নির্মাণ জরুরি।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ট্রাক টার্মিনালে গিয়ে জানা যায়, ভারতীয় ৭০০ ট্রাক আমদানি পণ্য নিয়ে গুদামে খালাসের অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ৮-১০ দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এতে ট্রাকের ভেতর দিন পার করতে হচ্ছে চালক ও সহযোগীদের।
পাঞ্জাব থেকে পণ্য নিয়ে আসা প্রমোদ কুমার সিংহ ও অমরজিৎ সিংহ বলেন, বন্দরে আটদিন ধরে পড়ে আছি। মাল খালাস হচ্ছে না। গুদামে জায়গা না থাকায় খালাস করতে পারছে না বন্দরের লোকজন। এ অবস্থায় তাদের থাকা-খাওয়া সবই চলছে ট্রাকের ভেতর।
বনগাঁর ট্রাকচালক পরিতোষ সরকার, প্রভাস পাল, জীবন মন্ডল, কার্তিক পালসহ অনেকে বলেন, বনগাঁর কালিতলা পার্কিংয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন থাকার পর গত সপ্তাহে বেনাপোল পোর্টে ট্রাক নিয়ে এসে বসে আছি। কবে মাল খালাস হবে বলতে পারছি না। তবে মাল ভর্তি ট্রাক রেখে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাশ দেখিয়ে বাড়িতে ফিরে যাই। আবার সকালে ট্রাকের কাছে চলে আসি। আমাদের খরচ কেউ দেখে না।
বেনাপোল বন্দরের কয়েকজন গুদামের ইনচার্জ বলেন, বর্তমানে প্রতিটি গুদামে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পণ্য আছে। এক ট্রাক পণ্য খালাস হলে ৫ ট্রাক পণ্য নিয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লোক চলে আসে। পণ্য রাখার জায়গার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা বলেন, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ও রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে বেনাপোল স্থলবন্দরের জায়গা সংকটসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য একাধিকবার নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেও কোনো আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, বেনাপোলে বৃহৎ একটি স্থলবন্দর থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা যদি প্রকৃত সুবিধা না পায়, সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের ন্যায় বেনাপোলের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন পোর্ট তৈরি হবে। ফলে ব্যবসায়ীরা এবং বন্দর উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এরই মধ্যে বেনাপোল বন্দরে ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ায় (সাইড ডোর) কনটেইনারের মাধ্যমে মালামাল আসছে যা হেডলোডে বন্দরে আনলোড হচ্ছে। এছাড়া কমলাপুরের মতো কনটেইনার অপারেশন খুব শিগগির চালু হতে যাচ্ছে। সুতরাং জায়গা অধিগ্রহণসহ অবকাঠামোগত দিকগুলো উন্নয়ন করা দরকার।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, আমদানি করা পণ্যের ট্রাক বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকলে আমদানিকারককে প্রতিদিনের জন্য ট্রাক প্রতি দুই হাজার টাকা ডেমারেজ গুনতে হয়। এছাড়া পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হওয়ারও শঙ্কা থাকে। আবার কাঁচামাল আটকে থাকলে পণ্য রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, স্থলবন্দরে পণ্যের ধারণক্ষমতা ৫৯ হাজার টন। কিন্তু সেখানে দ্বিগুণের বেশি পণ্য রাখা হচ্ছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার গতি ফেরায় আমদানি-রপ্তানিও বেড়েছে। এ কারণে পণ্য রাখার স্থান সংকুলান করা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, বেনাপোল বাইপাস সড়কের পাশের ছোট আঁচড়া গ্রামে ১০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বন্দর এলাকার আমদানি-রপ্তানি ফটকের পাশে ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আরও ১৬ একর জায়গা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। অধিগ্রহণকৃত জায়গায় শিগগির ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এরপর বন্দরের পণ্যজটের সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে।