ঢাকা ০৭:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নওগাঁয় দিন দিন বাড়ছে পুকুর, কমে যাচ্ছে ফসলি জমি

স্টাফ রিপোর্টার, নওগাঁ :  উত্তরাঞ্চলের অন্যতম শীর্ষ শস্য উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেলায় বিভিন্ন কারণে কমছে ফসলি জমি। তার মধ্যে পুকুর খনন অন্যতম। জেলার অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমিতে বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকে।

এতে ফসলের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং ভালো দাম না পাওয়ায় চাষিরা লাভের আশায় মাছ চাষে ঝুঁকছেন। মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় বাড়ছে পুকুর খনন। তবে কৃষি অফিসের দাবি, জমি কমলেও ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত জেলায় ৭৮৭ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জেলায় ৪০ হাজার ১৮টি পুকুর ছিল। যার পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৫১১ দশমিক ৭৫ হেক্টর।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৯২২টি, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪৬ হাজার ৯২৩টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ১০৪টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ১২২টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ১৭২টি। যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার ৮০০ দশমিক ৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে সরকারি পুকুর রয়েছে ৮ হাজার ৪৮০টি, যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৩৬৬ দশমিক ২৭ হেক্টর।

জেলার আত্রাই, রানীনগর, মান্দা ও সদর উপজেলার কিছু অংশ অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি। এসব এলাকা প্রথাগতভাবে ধান উৎপাদনের জন্য খ্যাত। অপরদিকে বদলগাছী, মহাদেবপুর, ধামইরহাট ও সদর উপজেলার কিছু অংশ সবজি উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত।

নিম্নাঞ্চলগুলোতে বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকায় বছরে একটিমাত্র ফসল বোরোর আবাদ হয়ে থাকে। ফসল কাটার সময় বৈরি আবহাওয়া না থাকলে সে বছর ঠিকমতো ফসল ঘরে তুলতে পারেন চাষিরা। আর প্রকৃতি বৈরি হলে সে বছর কৃষকদের কাঁচা ধান কেটে ঘরে তুলতে হয়।

বছরের পর বছর ধরে অনেক কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। এসব কারণে এক ফসলি ও দুই ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন তারা।অনেক চাষি সমস্যার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে অনুমতি নিয়ে পুকুর খনন করেছেন।

আবার অনেকে ঝামেলা এড়াতে লুকোচুরি করে ফসলি জমিগুলোতে পুকুর খনন করেছেন। মাটি ব্যবসায়ীরা জমির মালিকদের কিছু টাকা দিয়ে পুকুর খনন করে দেন। আর এসব মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় দিয়ে মাটি ব্যবসায়ীরা একটা লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। ফলে জমির মালিকদের নিজ খরচে পুকুর খননের দরকার পড়ে না।

আত্রাই উপজেলার কালীকাপুর গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান জানান, তিনি গত দুই বছরে উপজেলায় প্রায় ১৫-১৬টি পুকুর খনন করে দিয়েছেন। যার পরিমাণ প্রায় ২০০ বিঘার মতো। এক ফসলি জমির মালিকরা বছরে ৫ হাজার টাকায় জমি ইজারা দিত।

যেখানে অন্য কৃষক জমি ইজারা নিয়ে ফসল ফলিয়ে খরচ বাদে বছর শেষে ৮-১০ হাজার টাকা থাকত। এখন মালিকরা ওই জমিগুলো একজন ব্যবসায়ীকে ইজারা দিয়েছে। সেই জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বিনিময়ে জমির মালিক বছর শেষে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে।

সদর উপজেলার চুনিয়াগাড়ী গ্রামের চাষি নকিমউদ্দিন দুই বছর আগে চার বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। প্রথম বছর মাছের দাম ভালো পাওয়া গেলেও এ বছর দাম তুলনামূলক কম। তবুও মাছ চাষ লাভজনক বলে জানান তিনি। এছাড়া পুকুর পাড়ে ফলের গাছ ও শাকসবজি চাষ করে বাড়তি আয় করা যায়।

তিনি বলেন, যে জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে সেখানে বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি জমে থাকে। বছরের একটিমাত্র ফসল বোরো আবাদ করা যায়। তারপরে আবহাওয়া খারাপ থাকলে সে বছর বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচাতে আগেই ধান ওঠাতে হয়। আবার কষ্ট করে ফসল ফলিয়ে ন্যায্য দামও পাওয়া যেত না।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সামশুল ওয়াদুদ বলেন, বছর বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। তবে উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের উৎপাদন বেশি হওয়ায় ফসলের পরিমাণও বাড়ছে। একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন হচ্ছে। এ কারণে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রতি বছর যদি কৃষিজমির পরিমাণ কমতে থাকলে সেটা ভাবনার বিষয়।

নওগাঁ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, তিনফসলি জমিতে প্রশাসন এবং মৎস্য অফিস থেকে পুকুর খননে কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। এক ফসলি জমি বিশেষ করে বছরের ৬-৭ মাস জলাবদ্ধতা থাকে। এক্ষেত্রে জমির মালিক আমাদের কাছে আবেদন করলে বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়।

তিনি আরও বলেন, একফসলি জমিতে ফসল করে আসলে লাভ করা সম্ভব না। এজন্য এসব জমিতে পুকুর খনন করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে।

এক বিঘা জমির পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে বছরের প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। আবার কোনো কোনো পুকুর থেকে ৫০ হাজার টাকাও আয় হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ফসলের তুলনায় মাছ চাষ লাভজনক। এ কারণে এক ফসলি জমির মালিকদের মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষে আগ্রহ বাড়ছে।

ট্যাগস

নওগাঁয় দিন দিন বাড়ছে পুকুর, কমে যাচ্ছে ফসলি জমি

আপডেট সময় ১১:২১:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ জুলাই ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার, নওগাঁ :  উত্তরাঞ্চলের অন্যতম শীর্ষ শস্য উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেলায় বিভিন্ন কারণে কমছে ফসলি জমি। তার মধ্যে পুকুর খনন অন্যতম। জেলার অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমিতে বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকে।

এতে ফসলের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং ভালো দাম না পাওয়ায় চাষিরা লাভের আশায় মাছ চাষে ঝুঁকছেন। মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় বাড়ছে পুকুর খনন। তবে কৃষি অফিসের দাবি, জমি কমলেও ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত জেলায় ৭৮৭ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জেলায় ৪০ হাজার ১৮টি পুকুর ছিল। যার পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৫১১ দশমিক ৭৫ হেক্টর।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৯২২টি, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪৬ হাজার ৯২৩টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ১০৪টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ১২২টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ১৭২টি। যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার ৮০০ দশমিক ৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে সরকারি পুকুর রয়েছে ৮ হাজার ৪৮০টি, যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৩৬৬ দশমিক ২৭ হেক্টর।

জেলার আত্রাই, রানীনগর, মান্দা ও সদর উপজেলার কিছু অংশ অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি। এসব এলাকা প্রথাগতভাবে ধান উৎপাদনের জন্য খ্যাত। অপরদিকে বদলগাছী, মহাদেবপুর, ধামইরহাট ও সদর উপজেলার কিছু অংশ সবজি উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত।

নিম্নাঞ্চলগুলোতে বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকায় বছরে একটিমাত্র ফসল বোরোর আবাদ হয়ে থাকে। ফসল কাটার সময় বৈরি আবহাওয়া না থাকলে সে বছর ঠিকমতো ফসল ঘরে তুলতে পারেন চাষিরা। আর প্রকৃতি বৈরি হলে সে বছর কৃষকদের কাঁচা ধান কেটে ঘরে তুলতে হয়।

বছরের পর বছর ধরে অনেক কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। এসব কারণে এক ফসলি ও দুই ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন তারা।অনেক চাষি সমস্যার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে অনুমতি নিয়ে পুকুর খনন করেছেন।

আবার অনেকে ঝামেলা এড়াতে লুকোচুরি করে ফসলি জমিগুলোতে পুকুর খনন করেছেন। মাটি ব্যবসায়ীরা জমির মালিকদের কিছু টাকা দিয়ে পুকুর খনন করে দেন। আর এসব মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় দিয়ে মাটি ব্যবসায়ীরা একটা লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। ফলে জমির মালিকদের নিজ খরচে পুকুর খননের দরকার পড়ে না।

আত্রাই উপজেলার কালীকাপুর গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান জানান, তিনি গত দুই বছরে উপজেলায় প্রায় ১৫-১৬টি পুকুর খনন করে দিয়েছেন। যার পরিমাণ প্রায় ২০০ বিঘার মতো। এক ফসলি জমির মালিকরা বছরে ৫ হাজার টাকায় জমি ইজারা দিত।

যেখানে অন্য কৃষক জমি ইজারা নিয়ে ফসল ফলিয়ে খরচ বাদে বছর শেষে ৮-১০ হাজার টাকা থাকত। এখন মালিকরা ওই জমিগুলো একজন ব্যবসায়ীকে ইজারা দিয়েছে। সেই জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বিনিময়ে জমির মালিক বছর শেষে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে।

সদর উপজেলার চুনিয়াগাড়ী গ্রামের চাষি নকিমউদ্দিন দুই বছর আগে চার বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। প্রথম বছর মাছের দাম ভালো পাওয়া গেলেও এ বছর দাম তুলনামূলক কম। তবুও মাছ চাষ লাভজনক বলে জানান তিনি। এছাড়া পুকুর পাড়ে ফলের গাছ ও শাকসবজি চাষ করে বাড়তি আয় করা যায়।

তিনি বলেন, যে জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে সেখানে বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি জমে থাকে। বছরের একটিমাত্র ফসল বোরো আবাদ করা যায়। তারপরে আবহাওয়া খারাপ থাকলে সে বছর বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচাতে আগেই ধান ওঠাতে হয়। আবার কষ্ট করে ফসল ফলিয়ে ন্যায্য দামও পাওয়া যেত না।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সামশুল ওয়াদুদ বলেন, বছর বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। তবে উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের উৎপাদন বেশি হওয়ায় ফসলের পরিমাণও বাড়ছে। একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন হচ্ছে। এ কারণে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রতি বছর যদি কৃষিজমির পরিমাণ কমতে থাকলে সেটা ভাবনার বিষয়।

নওগাঁ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, তিনফসলি জমিতে প্রশাসন এবং মৎস্য অফিস থেকে পুকুর খননে কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। এক ফসলি জমি বিশেষ করে বছরের ৬-৭ মাস জলাবদ্ধতা থাকে। এক্ষেত্রে জমির মালিক আমাদের কাছে আবেদন করলে বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়।

তিনি আরও বলেন, একফসলি জমিতে ফসল করে আসলে লাভ করা সম্ভব না। এজন্য এসব জমিতে পুকুর খনন করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে।

এক বিঘা জমির পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে বছরের প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। আবার কোনো কোনো পুকুর থেকে ৫০ হাজার টাকাও আয় হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ফসলের তুলনায় মাছ চাষ লাভজনক। এ কারণে এক ফসলি জমির মালিকদের মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষে আগ্রহ বাড়ছে।