খুলনা প্রতিনিধি: খুলনা মহানগরীর শিরোমনি থেকে অটোরিকশায় করে দৌলতপুরে ওয়াজ মাহফিলে যাচ্ছিলেন কাঁচামাল ব্যবসায়ী ইলিয়াস মুন্সি। অটোরিকশাটি খানজাহান আলী থানার ফুলবাড়ীগেট মোদাচ্ছের মার্কেটের সামনে এলে শিরোমনিগামী বেপরোয়া গতিতে আসা একটি ট্রাক ধাক্কা দেয়।
এ সময় তিনি ছিটকে পড়লে ট্রাকটি তাকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সোমবার (১ মার্চ) রাত সাড়ে ৯ টায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। একই রাতে মোটরসাইকেলে করে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাগেরহাটের দিকে যাচ্ছিলেন মাহবুব।
শ্রীঘাট এলাকায় পৌঁছালে একটি ট্রাকের ধাক্কায় মাহবুব ও তার স্ত্রী মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই ফাতেমা বেগম মারা যায়। স্থানীয়রা আহত মাহবুবকে উদ্ধার করে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে পাঠান।
খুলনা মহানগরীর আড়ংঘাটা এলাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ট্রাকচাপায় মিরাজ ও মো. ফাহাদ নামের দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) খুলনা থেকে যশোরগামী একটি গড়াই পরিবহন ও যশোর থেকে খুলনাগামী একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
এ ঘটনায় ট্রাকচালক নিহত হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) ব্যস্ততম খুলনা সিটি বাইপাস সড়কে নির্মাণাধীন কারাগারের কাছে ট্রাকচাপায় সাইফুল (৩৫) ও নাঈম (২৬) মোটরসাইকেলের দুই আরোহীর প্রাণ ঝরে যায়।
১১ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) খুলনা-যশোর মহাসড়কের ফুলতলা এম এম কলেজ মোড়ে যশোরগামী ট্রাকের ধাক্কায় শুকুর আলী শেখ (৫৬) নামে এক সাইকেল আরোহী ঘটনাস্থলেই মারা যান। শুকুর কাঁচামাল ব্যবসায়ী ছিলেন।
২৮ জানুয়ারি খুলনার পাইকগাছায় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিব সরদার ট্রাক চাপায় নিহত হন। সাকিবের চাচা আল-আমিনের সঙ্গে মোটরসাইকেল করে ফুফুর বাড়ি যাওয়ার পথে কপিলমুনির দরগাহমহল মোড় নামক স্থানে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক তাদের ধাক্কা দেয়।
এতে মোটরসাইকেল আরোহী সাকিব ছিটকে পড়ে নিহত হয়। ১৮ জানুয়ারি খুলনায় পাট বোঝাই ট্রাকের চাপায় খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বেগ আনিসুর রহমান (৫২) নিহত হন।
১৫ জানুয়ারি সকাল নয়টার দিকে গল্লামারী জিরোপয়েন্টে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায় নিরালা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা মাহাবুবুল্লাহ আশিক (১৭) ও বাগমারা এলাকার উত্তম কুমার সিনহা পাখি (৩২) নামের দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন।
চলতি বছরের গেল দুই মাসেই বেপরোয়া গতির ট্রাকের একের পর এক এভাবে প্রাণ ঝরেছে খুলনার সড়কে। আর কত প্রাণ ঝরলে, আর কত মানুষের রক্তে সড়ক-মহাসড়ক রঞ্জিত হলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কমবে? দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার-পরিজনের হৃদয় বিদীর্ণ করা আহাজারি আর কত দেখতে হবে? সচেতন মানুষের মনে এসব প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, রূপসা সেতু বাইপাস সড়ক, খুলনা সিটি বাইপাস সড়ক, খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কে সবচেয়ে বেপরোয়াভাবে বালুর ট্রাক চলতে দেখা যায়। এছাড়া মোংলা বন্দর থেকে পণ্যবাহী ট্রাকও সড়কে চলছে অতিরিক্ত বোঝা নিয়ে বেপরোয়া গতিতে।
ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে ওভারলোডিং ট্রাক চলাচল করলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণে অজ্ঞাত কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। এছাড়া স্প্রিডব্রেকারের কোনো তোয়াক্কা না করেই ট্রাকগুলো তীব্র গতিতে ছুটে চলে। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।
পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতা, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তা ও পরিবহন মালিকদের আসকারা পেয়ে ট্রাকের চালক ও হেলপাররা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বেপরোয়া গতির কারণে সড়কে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বলেন, কোনোভাবেই থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই বেপরোয়া ট্রাকের কারণে খুলনার সড়কে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
এতে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। পাশাপাশি দুর্ঘটনায় আহতরা পঙ্গুত্ববরণ করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। যে হারে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, তা যেন জাতীয় দুর্যোগে রূপ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে গাড়ি চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিং, মাদকাসক্ত চালক-হেলপার, ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, সড়কের খানা-খন্দ ও বিপজ্জনক মোড়।
মালিক-শ্রমিকদের লোভের কারণে গতি বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা মানুষের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছে। সড়কে প্রতিনিয়ত যে প্রাণ ঝরছে, এর রাশ টানতেই হবে।
কেউ যাতে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স না নেয়, গাড়ি যেন হেলপারদের দ্বারা চালানো না হয়, একই সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হলে একটি সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন যেমন তদারকির দিক থেকে সচেষ্ট থাকবে, তেমনি চালক নিয়োগ দিতে মালিকদেরও সতর্কতা প্রয়োজন। যাত্রীদের সচেতনতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মঙ্গলবার (২ মার্চ) সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের পদক্ষেপ বিষয়ে কাটাখালি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলী হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশের হেডকোয়াটারের অনুমতি ছাড়া মিডিয়াতে কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না।