গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং ধীরে ধীরে ‘নীরব বিপ্লব’ সৃষ্টি করেছে। ২০১৩ সালে চালু হওয়া এই ব্যবস্থা ব্যাংকের শাখা ছাড়া গ্রাহককে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে নতুন ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এক যুগে এটি শুধু গ্রাহক সংখ্যা, আমানত ও ঋণ বিতরণে নয়, প্রবাসী আয় সংগ্রহেও রেকর্ড ভেঙেছে।
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর এই সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত সংগ্রহ হয়েছে ৪৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে একাই ইসলামী ব্যাংক সংগ্রহ করেছে ২১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে ঋণ বিতরণে এগিয়ে আছে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক।
জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো ৩০টি ব্যাংক মিলিয়ে ঋণ বিতরণ করেছে ৩১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক একাই বিতরণ করেছে ২২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৩০টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব ব্যাংকের মোট এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাবের পরিমাণ ২ কোটি ৫১ লাখ ৩৯ হাজার ২৯৩ কোটি। এর মধ্যে শীর্ষে থাকা ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৭৬ লাখ ১৩ হাজার ৬২১টি।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্যাংক এশিয়ার অ্যাকাউন্ট ৭৪ লাখ ৩৫ হাজার ৭২৭টি। এবং ইসলামী ব্যাংকের হিসাবের সংখ্যা ৫৬ লাখ ১০ হাজার ১৪৫টি।
বর্তমানে দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে ২০ হাজার ৪৮৮টি। এর মধ্যে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ৫ হাজার ৬২০টি, ব্যাংক এশিয়ার ৫ হাজার ৩৫টি এবং ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটের পরিমাণ ২ হাজার ৭৯২টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট চালানো ৩০টি ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করেছে ৪৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, গত বছরের একই সময় যা ছিল ৩৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৮ হাজার ৭১ কোটি টাকা।
আর চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঋণ বিতরণ করেছে ৩১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণ ছিল ২১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮২২ কোটি টাকা।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আমানত সংগ্রহ করেছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ করেছে ২১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ডাচ বাংলা ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করেছে ৬ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্যাংক এশিয়া সংগ্রহ করেছে ৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
ঋণ বিতরণে শীর্ষে থাকা ব্র্যাক ব্যাংক বিতরণ করেছে ২২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সিটি ব্যাংক বিতরণ করেছে ৩ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্যাংক এশিয়া বিতরণ করেছে ১ হাজার ৬৮৪ কোটি।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন সহজ করতেই মূলত এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হয়েছে। এটা এখন সারাদেশে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ সাধারণ মানুষ হাতের কাছে ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে পারছেন। এমনকি সাধারণ মানুষ এখন এসব এজেন্ট ব্যাংকিং থেকে ঋণও নিতে পারছে। যার ফলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ব্যতিক্রম ছাড়া সবকটি সূচকে অতীতের রেকর্ড ভেঙে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘চব্বিশ সালের আগস্টে দেশে যে পরিবর্তন হয়েছে, তার ধাক্কা কিছুটা এই সেবায়ও লেগেছে। সেবাটির আরও বিস্তৃতি ঘটানোর পাশাপাশি নতুন কিছু করা গেলে গ্রাহক ও লেনদেন আরও বাড়বে। নতুন সেবার মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং আমানতের সঙ্গে বিমা সুবিধা চালু করা হচ্ছে। ঘরের কাছে হাত বাড়ালে এজেন্ট সেবা মিলছে। এজেন্টদের মাধ্যমে ব্যাংকের অনেক সেবা মিলছে। সেজন্য এজেন্টে ব্যাপক সাড়া মিলছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হিসাব সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪০ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৫টি। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর শেষে এই অ্যাকাউন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৫১ লাখ ৭ হাজার ১৬৪টি। অর্থাৎ ৯ মাসের অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ১০ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৯টি।
একই সময়ে আমানত বেড়েছে ৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত ছিল ৪১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা
সংশ্লিষ্টদের মতে, এজেন্ট ব্যাংকিং ধীরে ধীরে একটি কার্যকর মাধ্যম হয়ে উঠছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও ব্যাংকিংসেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে প্রবাসী আয় পৌঁছে দিতে সবচেয়ে কার্যকর চ্যানেল হয়ে উঠেছে। মূলত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে নিরাপদ আর্থিক সেবা পৌঁছে দিতে বিকল্প হিসেবে ২০১৩ সালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সূচনা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের রেকর্ড ভঙ্গ কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে আর্থিক সেবা পৌঁছে দিতে বিপ্লব বয়ে এনেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং এখন প্রবাসী আয় বিতরণের অন্যতম চ্যানেলে পরিণত হয়েছে। এটি প্রত্যন্ত এলাকার পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে যুক্ত করেছে।’

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা: 



















