বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় গত দেড় বছরে বাংলাদেশ সরকার অগতানুগতিক বা অপ্রথাগত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রবাসী আয় কমেছে; অন্যদিকে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
এ ছাড়া রেটিং সংস্থাগুলো বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে। নীতিনির্ধারকেরা অপ্রথাগত নীতি গ্রহণের কারণেই সংকট বেড়েছে।ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) বার্ষিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন জাহিদ হোসেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আইবিএফবির সভাপতি ও এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদ।
বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কমছে, তেমনি রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, তা বিপজ্জনক না হলেও উদ্বেগের পর্যায়ে এসে গেছে
জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ঢাকা কার্যালয়, বিশ্বব্যাংক অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পেছনে বৈশ্বিক কারণের সঙ্গে দেশীয় কারণও আছে। সরকারের অগতানুগতিক নীতির কারণে গত দুই বছরে প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহও কমছে।
বাজারে চাহিবামাত্র বিদেশি মুদ্রা পাওয়া না গেলে মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক, বাজারভিত্তিক, নমনীয় ও একক বিনিময় হার নির্ধারণ করে লাভ হবে না বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করতে পারেনি বলে জানান জাহিদ হোসেন। বলেন, দুর্বল নীতি গ্রহণের কারণে বিদেশি রেটিং সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের ঋণমান স্থিতিশীল অবস্থা থেকে কমিয়ে নেতিবাচক করেছে।অনুষ্ঠানে জাহিদ হোসেন আরও বলেন, করোনার সময় থেকে দেশের সামষ্টিক আর্থিক স্থিতিশীলতায় দুর্বলতা বেড়েছে। যেমন গত ২২ মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় ধরনের মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। পাশাপাশি ডলার–সংকট সৃষ্টি, উদ্বেগজনকভাবে রিজার্ভ কমা ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ও সরকারের আর্থিক নীতির সমালোচনা করেন জাহিদ হোসেন। তাঁর ভাষায় এটি ‘অনন্য’। কারণ, এটি এক দিক থেকে সংকোচনমূলক, আরেক দিক থেকে সম্প্রসারণমূলক। এ ধরনের নীতিকে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। আবার বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমলেও সরকারের ঋণ বাড়ছে। এ ছাড়া প্রত্যাশা অনুসারে রাজস্ব আদায় এবং তা ব্যয় করা যাচ্ছে না। এর ফলে ঘাটতি বাড়ছে।বিশ্ববাজারে তেলের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, এ কারণে অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়ছে।এতে যেমন বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কমছে, তেমনি রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, তা বিপজ্জনক না হলেও উদ্বেগের পর্যায়ে এসে গেছে। এ ছাড়া আইএমএফের প্রোগ্রামের মাধ্যমে যেসব সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সফলতা নিয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না বলে জানান জাহিদ হোসেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধির প্রবণতা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দেন জাহিদ হোসেন। তিনি জানান, অতীতে যে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি ছিল, তাতে কিছুটা ধীরগতি এসেছে। অর্থাৎ দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত কমেছে। দেশে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সূচকেও উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বড় বিষফোড়া হিসেবে আর্থিক বৈষম্য অনেক বেড়েছে। এ অবস্থায় উচ্চ মধ্যম আয়ের বা উচ্চ আয়ের দেশে পৌঁছার যে লক্ষ্য রয়েছে, কাঙ্ক্ষিত সময়ে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে তিনটি জায়গায় কাজ করতে হবে। এক. অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। দুই. শ্রমিকের আয় বাড়াতে হবে। কারণ, আয় না বাড়ালে বৈষম্য কমানো যাবে না। তিন. উপরিউক্ত দুটো কাজের জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর বিনিয়োগ। আর বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আর্থিক খাতে যেসব দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে।
জাহিদ হোসেন বলেন, এসব কাজের ক্ষেত্রে কিছু বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, দুই দেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত জুলাই মাসে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রুপিতে পরিমিতভাবে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হয়েছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
আইবিএফবির সভাপতি হুমায়ুন রশীদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর্থিক খাতে দুর্নীতি, বিনিয়োগ কমা, সরবরাহ ব্যবস্থায় দুর্বলতা, মেধাস্বত্বের সুরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন।’