স্টাফ রিপোর্টার নওগাঁ: নওগাঁর পত্নীতলায় এক গৃহবধুকে গত তিন মাস থেকে বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিতা ওই গৃহবধুর নাম আমিনা বেগম। দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে ওই গৃহবধুর দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। গৃহবধুর স্বামীর নাম ফারুক ইসলাম (ফেন্সি) (৪৫)। তিনি আদম ব্যাপারি। থাকেন ব্রনাই দেশে।
তাদের বাড়ি উপজেলার নজিপুর পৌরসভার হরিরামপুর পশ্চিমপাড়ায়। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে ওই গৃহবধুর মা লাইলি বেগম থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়েছে ।
গৃহবধুর পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত আট বছর আগে ধামইরহাট উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ভেড়ম সোনাদিঘী গ্রামের মৃত আব্দুল হাই এর ছেলে ফারুক ইসলাম ফেন্সির সঙ্গে পতœীতলা উপজেলার আকবরপুর ইউনিয়নের বনী গ্রামের লুৎফর রহমানের মেয়ে আমিনা বেগমের বিয়ে হয়।মেয়ের সুখের জন্য বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে নগদ ২ লাখ টাকা দেয় ফারুক কে । বিয়ের দুই বছর ফারুক ইসলাম ফেন্সি তার স্ত্রী আমিনাকে বেড়ানো কথা বলে ব্রনাই নিয়ে যান। সেখানে প্রায় আট মাস ছিলেন আমিনা।
এর মধ্যে তার ওপর বিভিন্ন নির্যাতন চালানো হয়। ব্রনাই দেশে কর্মসংস্থান করে দেওয়ার আশায় এলাকার বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে যান ফেন্সি। এর মধ্যে অনেকেই প্রতারিত হয়ে ফিরে আসেন।কয়েক বছর আগে পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভার হরিরামপুর পশ্চিমপাড়ায় জমি কিনে সেখানে চারতলা ভবন নির্মান করেছেন ফেন্সি। সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। এর মধ্যে দুই সন্তান ফারহানা ফিন্নি (৫) ও ফারিয়া আক্তার রাখি (২) জন্ম নেয়। শ^াশুড়ি লাইলি বেগম ও শালিকা তাদের সঙ্গে বসবাস করতো।সর্বশেষ গত তিন বছর আগে ফারুক দেশে আসছিলেন। গত এক বছর আগে এক ব্যক্তিকে বিদেশ নিয়ে যান। এই সুযোগে ওই ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইলে পরকিয়া শুরু করেন। এরপর থেকে স্ত্রী আমিনার প্রতি তৈরি হয় আস্থাহীনতা । স্ত্রী সন্তানদের খোঁজ খবর নেওয়া বন্ধের পাশাপাশী যোগাযোগ ছিন্ন করার চেষ্টা চালায় । হটাৎ একদিন স্ত্রী আমিনা জানতে পাওে তাকে মোবাইলে তালাক দেওয়া হয়েছে ।
। এরপর তিন মাস থেকে ফারুক তার মাকে তার বাসায় রেখেছেন। বাসার মুল দরজা সব সময় তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। প্রয়োজনেও বাসার বাহিরে বের হওয়া সম্ভব হয়না। গৃহবন্দি হয়ে আছেন আমিনা। তার সন্তান স্কুলেও ঠিকমতো যেতে পারছে না।
এমনকি তাদের ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হচ্ছে না।গত সোমবার (২৮ মার্চ) বড় মেয়ে ফারহানা ফিন্নি স্কুলে যাবে এজন্য শাশুড়িকে দরজা খুলতে বলা হয়। কিন্তু উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে শাশুড়ি, ননদ, মিন্টু পরাগ, বদুল, সাগর ও ম্যানেজার বেলাল ওই গৃহবধুকে মারপিট করে। এতে তার নাক ফেটে রক্ত বের হয়। নির্যাতনের পর গৃহবধুকে চিকিৎসাও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ইতিপূর্বেও সালিস বৈঠক করেছেন। সেখানে খাওয়া পরা ও মেয়েদের পড়াশুনা বাবদ মাসে ১২ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু তিন মাসে মাত্র ৫ হাজার টাকা তাদের দেওয়া হয়েছে।গৃহবধুর মা লাইলি বেগম বলেন, মেয়েকে ব্রনাই নিয়ে যাবে এজন্য সে সময় মেয়ের জন্য ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ভিসা ও পার্সপোর্ট করে দেয়া হয়। মেয়ের সঙ্গে আমাকে থাকার জন্য জামাই অনুরোধ করেছিল। পরে নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে প্রায় ২৯ লাখ টাকা দিয়ে নজিপুর শহরে জমি কেনা ও বাসার কাজে খরচ করা হয়। গত চার বছর থেকে মেয়ের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু গত তিন মাস থেকে আমার মেয়ের ওপর তার শাশুড়ির ও আত্মীয় স্বজনরা নির্যাতন করছে। আমার মেয়েকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। থানায় অভিযোগ দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অভিযোগ না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার দাবী করছি।
ভুক্তভোগী গৃহবধু আমিনা বেগম বলেন, স্বামী অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পর থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে। স্বামী এখনো বিদেশ থাকে। কিন্তু কয়েকদিন আগেও স্বামী তার ম্যানেজার বেলাল এর মাধ্যমে পরকিয়ার ওই মহিলা নিপাকে আমার বাসায় জোর করে রাখে। কারণে অকারণে আমাকে শশুর বাড়ির লোকজন নির্যাতন করছে। পুলিশকে ফোন করেছিলাম কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আমার জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছি।আমিনা বেগমের শাশুড়ির ফাতেমা বেগম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছেলে বিদেশ থাকে। ছেলের কথায় তিন মাস থেকে তার বাসায় থাকছি। ছেলের বউকে কোন ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। বরং আমাকেই মারপিট করেছে ছেলের বউ। এছাড়া আমার ছেলে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরকিয়া জড়িত না। বাসার মুল দরজায় তালাবদ্ধ রাখা, নাতনীদের স্কুলে যেতে না দেওয়া ও খাবার দেওয়া হয়না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সবসময় দরজা না খোলার জন্য ছেলের নিশেধ আছে। নাতনী নিয়মিত স্কুলে যায়।
আর খাবার না দিলে তারা এতোদিন বেঁচে আছে কিভাবে।স্থানীয় রুবেল হোসেন, জান্নাতুন বেগম ও মাহমুদা বলেন, ফারুক ইসলাম এক মহিলার সঙ্গে পরকিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে এ সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে। বেশ কিছুদিন থেকে আমিনা বেগমের কান্না ও চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বাসায় কিছুদিন থেকে ফারুকের মা (ফাতেমা) আছে। ছেলে যা বলে তিনি তাই করেন। সবসময় বাসার মুল দরজায় তিনি তালা লাগিয়ে রেখেছেন। আমিনা বেগমের দুই মেয়ে আছে। তাদেরকে ঠিকমতো স্কুলে যেতে ও খাবারও দেওয়া হচ্ছে না। ফারুক বিদেশ থাকে কিন্তু কয়েকদিন আগে পরকিয়া জড়িত ওই মহিলা এ বাসায় এসেছিলো। এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
অভিযুক্ত ফারুক ইসলামের সাথে মুঠো ফোনে কথা হলে তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমার স্ত্রীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়নি। বাসা বাড়ীর সিকিউরিটির বিষয় চিন্তা করে প্রধান গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আমি কোন দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। আমার স্ত্রীর বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমি দেশে যাওয়ার পর নিবো।
পত্নীতলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল গাফ্ফার বলেন, গত চার মাস আগে ওই পরিবারের বিষয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে ভরণপোষণ ও বাচ্চাদের পড়াশুনা বাবদ মাসে ১২ হাজার টাকা করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। তারা মেনেও নিয়েছেন। এছাড়া যেহেতু ওই গৃহবধুর স্বামী বিদেশ থাকেন তিনি দেশে ফিরে আসলে তারা তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিবেন।
পত্নীতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আলম শাহ বলেন, ওই পরিবারের বিষয়ে থানায় লিখিত কোন অভিযোগ দেওয়া হয়নি। গৃহবধুকে নির্যাতন করা হয়েছে মর্মে তার মা (লাইলি বেগম) মৌখিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঘটনাস্থলে দুইজন পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।