নওগাঁবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ বিল পাস হয়ে সেই প্রতাশা পূরণ হয়েছে। তবে বিল পাস হয়ে ৮ মাস অতিবাহিত হলেও জায়গা জটিলতায় আটকে আছে স্থান নির্বাচন।
কোথায় হবে বিশ্ববিদ্যালয়, এ নিয়ে নওগাঁবাসীর মধ্যে রয়েছে অনেক মত। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে নওগাঁবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে জেলার এক জনসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর চার বছর পর ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত বিলের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।
এরপর ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জাতীয় সংসদে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ বিলটি পাসের জন্য উপস্থাপন করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করেন। পরে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।
এরপর ৮ জুন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নওগাঁ শহরের পার্শ্ববর্তী দিঘলীর বিল, নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়ার বিল, মহাদেবপুর উপজেলার নওহাটা (চৌমাশিয়া বাজার) এবং বদলগাছীর ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার সংলগ্ন চারটি স্থান প্রাথমিকভাবে আলোচনায় আসে। এরপর নওগাঁ শহরের আশপাশে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রায় ১২ বার মানববন্ধন করেছেন শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীসহ স্থানীয় কিছু সংগঠন। নওগাঁর নওহাটায় (চৌমাশিয়া বাজার) স্থাপনের দাবিতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সচেতন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় দুই শতাধিক মানুষ মানববন্ধন করেন। এরপর গত ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় স্থান নির্ধারণ কমিটির ব্যানার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত স্থান নওগাঁর তালতলিতে বঙ্গবন্ধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানিয়ে শহরের মুক্তির মোড়ে শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন করেন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ।
যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও সুষ্ঠু পরিবেশ যেখানে ভালো এমন যৌক্তিক স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপনের দাবি জানিয়ে ২৬ জুলাই ‘মুভমেন্ট ফর ডেভলপমেন্ট অব নওগাঁ’ সংগঠনের আহ্বায়ক শফিকুর রহমান মামুনের সভাপতিত্বে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি নওগাঁর নওহাটায় (চৌমাশিয়া বাজার) স্থাপনের দাবিতে নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কের মহাদেবপুর উপজেলার চৌমাশিয়া বাজারে শোভাযাত্রা করে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ‘হেল্প লাইন, হ্যালো নওগাঁ’।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, শহরের খুব কাছাকাছি নয়, আবার শহর থেকে খুব দূরেও নয় এমন স্থান নির্বাচনের বিষয়ে নজর দিতে হবে। এমতাবস্থায় দিঘলীর বিলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে নওগাঁ শহরের ওপর চাপ বাড়বে। আবার ছাতড়ার বিল সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ততোটা উন্নত না। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়বেন। সেক্ষেত্রে শহর থেকে খুব দূরে নয় এমন স্থান নির্বাচন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সকলে সড়ক ও রেলপথের সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা পাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচন নিয়ে নওগাঁ একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডি. এম আব্দুল বারি বলেন, শহরের পাশে এমন জায়গা হতে হবে যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ সকল সুবিধা পাবেন। এমতাবস্থায় মহাদেবপুর উপজেলার চৌমাশিয়া বাজারের কথা বলা যায়। সেখান থেকে শহর অনেকটা কাছে। কিন্তু ছাতড়ার বিল সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকায়। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ততোটা উন্নত না হওয়ায় সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. নাজমুল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শহরের পাশে এমন জায়গায় হতে হবে যেখান থেকে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরা শহরের সকল সুবিধা পেতে পারে। শহরের পাশে হলে সেখানে অনেক লোকের সমাগম হবে এবং নতুন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এলাকার অনেক বেকার যুবক সেখানে ব্যবসা করতে পারবে।
নওগাঁ সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক মো. শরিফুল ইসলাম খান বলেন, মহাদেবপুর উপজেলার চৌমাশিয়া বাজারটি শহরের খুব কাছাকাছি নয়, আবার শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে। নওহাটা মোড়ের ওপর দিয়ে বিভাগীয় শহর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ নওগাঁর সাতটি উপজেলায় যাওয়া যায়। এখান থেকে পার্শ্ববর্তী সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনের সুবিধাও পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যাতায়াতের অনেক সুবিধা পাবে। নওহাটা বাজারের পাশে রয়েছে প্রায় ৩০০ একর খাস জমি। এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে জমি অধিগ্রহণের খরচ অনেকাংশেই কমে যাবে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁর উপাচার্য প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি যতটুকু জানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইউজিসি বাজেট দিলে কাজ শুরু হবে। ২০২২ সালের নভেম্বরে যদি আমাকে নিয়োগ দিতো তাহলে ২৩-২৪ অর্থবছরে কাজ শুরু হতো, কিন্তু জুন মাসে নিয়োগ প্রদান করার কারণে সময় একটু বেশি লাগছে। কিন্তু কোথায় স্থান নির্বাচন করা হবে সে বিষয়ে আমার জানা নেই, সরকারের সুবিধা হবে এমন স্থান নির্বাচন করা হবে বলে জানান তিনি।
তবে এ বিষয়ে নওগাঁ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন ও নওগাঁ-১ আসনের সংসদ সদস্য খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার কথা বলতে রাজি হননি। খাদ্যমন্ত্রীর তথ্য ও গণসংযোগ কর্মকর্তা জনাব মো. কামাল হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানের কোনো সমাধান হবে না। প্রধানমন্ত্রী এটার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন