সাম্প্রতিক সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাটা হচ্ছে গাছ, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা থেকে গাছকাটার কারণ হিসেবে হাঁটার পথ এবং সাতটি রেস্টুরেন্ট হবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা নিয়ে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। কোনোভাবেই গাছ কাটাকে সমর্থন করছি না। কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছকাটা যাবে না?
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: গত ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা আরবান হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে। দূষণ কমিয়ে গাছ ও জলাভূমির পরিমাণ বাড়ানোই যেখানে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, সেখানে আরও গাছ কেটে ঢাকাকে আরও ভালনারেবল করে তোলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
২. হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য: একটা শহর হিসেবে ন্যূনতম যতটুকু বনভূমির দরকার হয় ঢাকার সেটা নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জলাশয় এবং পর্যাপ্ত গাছ থাকায় প্রচুর প্রাণীর বসবাস রয়েছে। গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট বানালে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পরবে এবং বাস্তুসংস্থান ভেঙে পরবে।
৩. ঐতিহাসিক কারণ: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য । ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রমনা রেসকোর্সে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এখানেই তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
আমাদের স্বাধীনতার পটভূমি রচিত হয়েছিল যে ভাষণে; ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক বঙ্গবন্ধু এই রেসকোর্স ময়দান থেকেই দেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী এখানে আত্মসমর্পণ করে।
১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ স্মরণ করতে “শিখা চিরন্তন ” এই উদ্যানে নির্মাণ করা হয়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা জাদুঘর এবং গ্লাস টাওয়ারও একটি দর্শনীয় স্থান।
৪. অক্সিজেন ফ্যাক্টরি: গাছ মানেই অক্সিজেনের অফুরন্ত উৎস। আবার ক্ষতিকর কার্বনডাই-অক্সাইড টেনে নিচ্ছে। কোভিড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে অক্সিজেনে সংকট কতটা ভয়াবহ হতে পারে। সেখানে অক্সিজেনের প্রাকৃতিক উৎসকে ধ্বংস করা টেকসই কোনো পরিকল্পনার অংশ হতে পারে না।
৫. জলাবদ্ধতা: ঢাকা শহরের সাধারণ ও অন্যতম সমস্যাগুলোর একটি জলাবদ্ধতা। উদ্যানে গাছ কেটে কংক্রিট ও টাইলস বসানোর ফলে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে যেতে বাধাগ্রস্ত হবে। ফলাফল হিসেবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া ঢাকা শহরে পানির স্তর ধীরে ধীরে আরও নিচে নামছে। এ রকম কংক্রিটের পথ পানিকে মাটির নিচে পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে আরও হুমকির মুখে ফেলবে।
৬. রিক্রিয়েশন: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হওয়ায় সবুজ প্রাঙ্গণটি অনেকে শিক্ষার্থীর আড্ডা দেওয়ার স্থান। বিকেল হলে টুং-টাং গিটারের আওয়াজ কিংবা দলে আবৃতি চর্চার দৃশ্যও চোখে পড়বে – অর্থাৎ উদ্যানে সংস্কৃতি চর্চার একটি আখরা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও এখানে ঘুরতে আসেন নানান বয়সী মানুষ – উদ্দেশ্য কংক্রিটের শহরে একটু সবুজের মাঝে নিশ্বাস নেওয়া। তাই উদ্যানের গাছ কেটে আনা পরিবর্তন শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশই বিনষ্ট করবে না, এর সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সাংস্কৃতিক বিকাশ।
৭. আবর্জনা তৈরির নতুন উৎস: বাংলাদেশের একটি সাধারণ মানের রেস্টুরেন্ট কী পরিমাণ আবর্জনা উৎপন্ন করে তার কোনো গবেষণার তথ্য এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায় আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া ছাড়া বাকি এরিয়াগুলোতে তেমন কার্যকর নয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাতটি রেস্টুরেন্ট তাদের উৎপন্ন করা ময়লার এক ভাগের অব্যবস্থাপনার ফলেও উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট হবে।
৮. প্রাকৃতিক পরিবেশ রূপান্তরিত হবে বাণিজ্যিক পরিবেশে: পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭টি রেস্টুরেন্টে নির্মাণ হলে উদ্যানের এই অংশটি আর প্রাকৃতিক ‘স্পেস’ থাকবে না। বরং একটি কমার্শিয়াল স্পেসে রূপান্তরিত হবে।
৯. নতুন গাছ লাগানোর পরিকল্পনায় ফাঁকি: গাছকাটার পর আরও এক হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। এতে অনেকেই গাছ কাটার বিষয়টিকে বৈধ ভাবছেন। কিন্তু নতুন করে গাছ লাগানো হলেও গাছকাটা যাবে না। কারণ ৫০ বছরের পরিণত গাছ যেভাবে পরিবেশ, বাস্তুসংস্থানে সাহায্য করে নতুন গাছ সেখানে কতটুকু ভূমিকা রাখবে? সাধারণত লম্বা শিরিষ গাছে চিল থাকে, উদ্যান সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর চিল বাস করে লম্বা গগণশিরিষ গাছে। এই গাছ কাটার পরে চিলেরা যে নিজের আবাস হারাবে তারা কী সদ্য লাগানো গাছে সেই আবাস ফিরে পাবে?
১০. অতীত থেকে শিক্ষা: গ্লাস টাওয়ার নির্মাণ করার সময় কিছু গাছ কাটতে হয়েছিল। সেগুলোর পরিবর্তে এখনো পর্যন্ত নতুন গাছ লাগানো হয়নি। তাছাড়া গ্লাস টাওয়ারের পাশে মার্বেল পাথর বসানো জায়গায় সূর্যের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপ বাড়তে থাকে। দুপুরবেলা পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও তাপের দাবদাহ ছুঁয়ে যাবে আপনাকে। পাথরের বদলে সবুজ ঘাস হলে চিত্রটা অন্যরকম হতে পারত।
লেখক: শিরিন সীমা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।