আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ নিত্যদিন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিষাক্ত ছোবলে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমতাবস্থায় ভাইরাস নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। এরই ধারাবাহিকতায় করোনাবিধ্বস্ত পৃথিবীকে ভাইরাস মোকাবিলা নিয়ে সুসংবাদ দিলেন বিজ্ঞানীরা।
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসা হিসেবে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যান্টিবডিভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতির খোঁজে ছিলে গবেষকেরা। এমন একটি অ্যান্টিবডি তারা তৈরি করতে চাইছিলেন, যা দিয়ে এ ধরনের রোগের চিকিৎসা সহজে করা যাবে। এত দিন পর এসে এ সম্পর্কিত একটি সুখবর দিলেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীদের একটি দল লামার (এক ধরনের প্রাণী) রক্তে থাকা অতি ক্ষুদ্র অ্যান্টিবডিকে ব্যাকটেরিয়াল সুপার গ্লুয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এভাবে সংযুক্ত অ্যান্টিবডি ইঁদুরের শরীরে প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইঁদুর দুটি ভয়ানক ভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে। একই সঙ্গে তারা অন্য জীবাণুও প্রতিহত করতে পারে।
সায়েন্সম্যাগে সম্প্রতি প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই পদ্ধতির মাধ্যমে জীবাণু প্রতিরোধে অনেকগুলো কঠিন ধাপকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোটিন প্রকৌশলী জেনিফার মেনার্ড বলেন, ‘এটি খুবই সাধারণ একটি প্রযুক্তি। এবং এটি বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি।’
সায়েন্সম্যাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবডি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরই মধ্যে বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারড অ্যান্টিবডি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় প্রয়োগের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু এ ধরনের কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করা অনেক কঠিন ব্যাপার। জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র এই কোষগুলোকে রূপান্তর করে তবেই একটি কার্যকর অ্যান্টিবডি পাওয়া সম্ভব।
একই সঙ্গে এই অ্যান্টিবডিকে শরীরে সক্রিয় করার জন্য প্রয়োজন সহায়ক অন্য কোষ। এ ক্ষেত্রে লামা, উট ও হাঙরের শরীরের অ্যান্টিবডি ব্যবহার তুলনামূলক সুবিধাজনক। কারণ, অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর অ্যান্টিবডি থেকে এগুলো অনেক ছোট এবং এর রূপান্তর তুলনামূলক সহজ। এই ছোট অ্যান্টিবডিগুলোকে বলে মিনিয়েচার অ্যান্টিবডি।
ওয়াজেনিংজেন বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চের অণুজীববিজ্ঞানী পল উইচগারস ও তার সহকর্মীদের লক্ষ্য ছিল, মিনিয়েচার অ্যান্টিবডি বানিয়া ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারে কিনা, তা খুঁজে দেখা। এই বানিয়া ভাইরাসকেই কিন্তু পরবর্তী মহামারির কারণ হতে পারে বলে বর্ণনা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই গোত্রের দুটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে গবেষকেরা এই অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখেন।
এ সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ই-লাইফ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, গবেষণাধীন দুটি ভাইরাসের মধ্যে একটি হচ্ছে রিফট ভ্যালি জ্বরের জন্য দায়ী ভাইরাস। এই ভাইরাস মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে গবাদিপশুর মধ্য সংক্রমিত হতে দেখা যায়, যা মাঝেমধ্যে মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। আরেকটি হলো স্মলেনবার্গ ভাইরাস, যা জার্মানিতে ২০১১ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই ভাইরাসটিও মূলত ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির মধ্য সংক্রমিত হয়। মানুষের মধ্যে দেখা যায় না।
লামাদের শরীরে এই দুই ভাইরাস প্রবেশ করানোর পর দেখা গেছে, লামার শরীরে ৭০ ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হচ্ছে, যা সংশ্লিষ্ট ভাইরাসগুলোর প্রোটিনে আটকে যাচ্ছে। এই অ্যান্টিবডিগুলোকে সংগ্রহ করে পরে এগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে দেখা যায় এই অ্যান্টিবডিগুলো একসঙ্গে ভালো কাজ করে। এগুলোকে যখন কোনো ব্যাকটেরিয়াল সুপার গ্লুয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, তখন এর কার্যকারিতা সর্বোচ্চ হয়। কারণ, এর মাধ্যমে একাধিক অ্যান্টিবডি পরস্পর সংযুক্ত থাকতে পারে, যা ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়তে পারে।
এর পর বিজ্ঞানীরা একটি ইঁদুরের ওপর এই জুড়ে দেওয়া অ্যান্টিবডিগুলো প্রয়োগ করেন। ওই ইঁদুরকে আগেই ওই দুই ভাইরাসের একটি এমন মাত্রায় দেওয়া হয়েছিল, যাতে তার মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী। এতে দেখা যায়, অ্যান্টিবডি দেওয়া হয়নি এমন রিফট ভ্যালি ফিভার ভাইরাসে সংক্রমিত সব ইঁদুর তিন দিনের মধ্যে মারা গেছে। কিন্তু যেগুলোকে অ্যান্টিবডি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ১০ দিন পরও জীবিত ছিল। অন্য ভাইরাসটির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি কাজ করেছে। তবে এই পদ্ধতি মানুষের ওপর প্রয়োগের আগে আরও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।