স্টাফ রিপোর্টারঃ শরীরে জ্বর। সঙ্গে সর্দি, কাশি ও গলা ব্যথা। প্রাণঘাতি করোনার উপসর্গ। নিশ্চিত হতে প্রয়োজন টেস্ট। যোগাযোগ করেন আইইডিসিআর হটলাইন নম্বরে। বারবার কল দিয়েও কাউকে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলো কয়েক দিন পর। ২৩শে এপ্রিল।
ততদিনে জ্বরে কাবু করছে বেশ। সব শোনার পরও তাৎক্ষণিক কোনো সেবা মিলেনি। নানা তদবিরের পরে অবশেষে ২৯শে এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ করে সরকারি এই সংস্থাটি। রেজাল্ট আসে করোনা পজেটিভ। করোনায় আক্রান্ত সাংবাদিক গাজী শাহ নেওয়াজ এভাবেই টেস্ট করাতে গিয়ে বিড়ম্বনার বিষয়টি প্রকাশ করেন। তিনি এখন চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় চিকিৎসাধীন।
একইভাবে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় বেগ পেতে হয়েছিলো আরেক সাংবাদিক এমদাদুল হক খানকে। তিনি বর্তমানে সুস্থ আছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৫ জন সংবাদকর্মী। এরমধ্যে মৃত্যু ঘটেছে দৈনিক সময়ের আলো’র প্রধান প্রতিবেদক হুমায়ুন কবির খোকনের।
এভাবেই প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। করোনা প্রতিরোধে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে সরকারের তরফে। আবার করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধের অংশ হিসেবেই ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে কয়েক পেশার মানুষকে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মী। সংবাদ সংগ্রহের জন্যই সাংবাদিকদের যেতে হচ্ছে বিভিন্নস্থানে। অলি-গলি থেকে শুরু করে হাট,বাজার, রাজপথ সর্বত্র যেতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এরমধ্যেই আক্রান্ত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। একইভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক ছাড়াও গণমাধ্যমের অন্যান্য বিভাগের কর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।
সাংবাদিকরা মনে করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি। এর কারণ হচ্ছে তারা সংবাদের প্রয়োজনে যাদের সঙ্গে কথা বলেন, যাদের কাছাকাছি যেতে হয় তারা ভাইরাসে আক্রান্ত কি-না এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। যে কারণে চিকিৎসকদের মতো সাংবাদিকদের আগাম কোনো প্রস্তুতি বা পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে না।
গণমাধ্যমকর্মীদের আক্রান্তের সংখ্যা বিষয়ে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ করছে ‘আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার’ ফেসবুক পেইজ। এর এডমিন সাংবাদিক আহম্মদ ফয়েজ জানান, রোববার পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত গণমাধ্যমকর্মী ৫৫ জন। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন, দৈনিক ইত্তেফাকের একজন রিপোর্টার, বাংলাভিশনের একজন রিপোর্টার, আরটিভির বার্তাকক্ষের একজন সংবাদকর্মী, এনটিভির দুই জন রিপোর্টার, একজন বার্তা সম্পাদক, ছয় জন ক্যামেরাম্যান, একজন সংবাদ উপস্থাপক, মেকাপম্যান, অনুষ্ঠান বিভাগের আরও চার জনসহ মোট আক্রান্ত ১৩ জন। নিউজ পোর্টাল বিবার্তার একজন রিপোর্টার, দীপ্ত টিভির পাঁচ সংবাদকর্মী,
দৈনিক ইনকিলাবের একজন রিপোর্টার, দৈনিক জনতার একজন রিপোর্টার, দৈনিক কালের কণ্ঠের একজন ফটোগ্রাফার, দৈনিক আমার বার্তা’র সম্পাদক, মাছরাঙা টিভির সাধারণ সেকশনের একজন কর্মকর্তা, নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষ্যা পত্রিকার সম্পাদক, রেডিও টুডের নারাযণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি, চ্যানেল আই এর অনুষ্ঠান বিভাগের একজন, নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমের জামালপুর প্রতিনিধি, দৈনিক আজকালের খবরের বামনা (বরগুনা) প্রতিনিধি, এসএ টিভির গাজীপুর প্রতিনিধি, যশোরের স্থানীয় দৈনিক লোকসমাজের একজন সাব-এডিটর, দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের একজন রিপোর্টার, নতুন সময় টিভির (আইপিটিভি) একজন সংবাদ উপস্থাপক, দৈনিক সময়ের আলো’র চার সংবাদকর্মী, রেডিও আমার’র একজন সংবাদকর্মী।
এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১১ জন। তারা হচ্ছেন, দৈনিক প্রথম আলোর একজন সংবাদকর্মী, ভোরের কাগজের বামনা উপজেলা (বরগুনা) প্রতিনিধি, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির একজন ক্যামেরাপার্সন, যমুনা টিভির একজন রিপোর্টার, দীপ্ত টিভির একজন রিপোর্টার, এটিএন নিউজের একজন রিপোর্টার, যমুনা টিভির নরসিংদী প্রতিনিধি, মানবজমিনের গাজীপুর প্রতিনিধি, বাংলাদেশের খবরের একজন রিপোর্টার ও দৈনিক সংগ্রামের একজন রিপোর্টার।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ চৌধুরী জানান, করোনা ভাইরাসে শনিবার পর্যন্ত ডিআরইউ’র ১০ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন পাঁচ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন। প্রত্যেক সদস্যকে যথাযথ সেবা, সুরক্ষা দিতে ডিআরইউ শুরু থেকেই তৎপর। দেশে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর শুরুতেই ডিআরইউ ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও করেছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ বলেন, ডিআরইউ’র ১৮শ সদস্যের বেশিরভাগই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। এরমধ্যে অন্তত পাঁচ শতাধিক সদস্য আর্থিক সঙ্কটে রয়েছেন। সাংবাদিকরাতো দেশের জন্যই কাজ করছেন। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা করোনায় মারা গেলে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি, একইভাবে সাংবাদিকদের জন্য সরকার ও মালিকপক্ষ যেনো প্রণোদনা দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
রফিকুল ইসলাম আজাদ বলেন, সরকার রেশন কার্ড করবে, এজন্য ডিআরইউ’র সদস্যদের তালিকা দিয়েছি তথ্য মন্ত্রনালয়ে। তাছাড়া ডিআরইউ থেকেও সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা দিতে চেষ্টা করছি। কিছু সুরক্ষা সামগ্রী দিয়েছি। করোনায় শহীদ সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন সম্পর্কে তিনি বলেন, ডিআরইউ’র ইন্সুরেন্সসহ আর্থিক সুবিধা তার পরিবার পাবে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে অর্থ দানের বিষয়ে আমরা চেষ্টা করছি। তথ্যমন্ত্রীও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। সকল সদস্যকে এই ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন থাকার অনুরোধ জানান ডিআরইউ সভাপতি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক খায়রুল আলম জানান, সংবাদকর্মীদের সুরক্ষার জন্য ডিইউজে মালিকপক্ষকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। সরকারকে আহবান জানাচ্ছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে। সেইসঙ্গে সংবাদকর্মীদের আর্থিক সুবিধার বিষয়ে সরকারের কাছে দাবি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাংবাদিকরা মনে করেন, সাংবাদিকতা পেশা করোনার জন্য অত্যন্ত ঝূঁকিপূর্ণ। তাই সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সহজে ও নিরাপদে নমুনা সংগ্রহ ও দ্রুত পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সাংবাদিকদের স্বাস্থ ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানান তারা।
সূত্রঃ মানবজমিন