নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিঃ প্রেমিকা দিশা মনিকে (১৫) বেড়াতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের পর হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনায় প্রেমিকসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গ্রেফতাররা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু ঘটনার ৪৫ দিন পর বাবা-মার কাছে ফোন করে ৪ হাজার টাকা চায় দিশা মনি।
মেয়ের ফোন পেয়ে হতভম্ব তার বাবা-মা। পরে দিশা মনি হত্যা মামলার তদন্তককারী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান তারা। এমন অবাস্তব সংবাদে পুলিশ প্রশাসনেও তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। পরে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে দিশা মনিকে উদ্ধার করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
সোমবার (২৪ আগস্ট) সকালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী দিশা মনিকে উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান।
গণধর্ষণের পর হত্যার শিকার হওয়া দিশা মনির ৪৫ দিন পর ফিরে আসার সংবাদে নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশের তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান জানান, দিশা মনিকে ৪৫ দিন পর উদ্ধার করা হয়েছে। দিশা মনি নিজে তার বাবা-মাকে ফোন করে টাকা চাইলে প্রথমে তার বাবা-মা প্রতারণা মনে করে পুলিশকে অবহিত করেন।
পরে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে মামলার তদন্তকারী অফিসার বন্দর উপজেলা থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন। একইসঙ্গে দিশা মনি এতদিন যার সঙ্গে আত্মগোপনে ছিল সেই ইকবাল ওরফে ইব্রাহিমকে আটক করা হয়েছে।
দিশা মনি ও ইকবাল থানা হেফাজতে রয়েছে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দিশা মনিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ফেলে-
দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার তিনজনকে আবার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কেন তারা হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তবে দিশা মনি ফিরে আসার ঘটনাটি আসলে অবাক হওয়ার বিষয় এবং চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কারোড এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে দিশা মনি। সে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
গত ৪ জুলাই থেকে সে নিখোঁজ হয়। আর ৬ আগস্ট দিশা মনির বাবা জাহাঙ্গীর আলম নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন।
সেসময় তিনি মামলায় উল্লেখ করেন, ‘এলকার যুবক আব্দুল্লাহ তার মেয়েকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে বিভিন্ন সময় প্রেমের প্রস্তাব দিত। এতে বাধা দিলে মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেয়।
গত ৪ জুলাই সন্ধ্যায় আব্দুল্লাহ ফোনে ঠিকানা দিলে তার মেয়ে সেই ঠিকানায় যায়। পরে তাকে গাড়িতে করে অপহরণ করে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা। এমন সন্দিহানের পর থেকেই তার মেয়ের কোনো সন্ধান পাননি তারা।’
ওই সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীম জানিয়েছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কারোড এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে দিশা মনির সঙ্গে বখাটে আবদুল্লাহ তার বন্ধু ইজিবাইক চালক রকিবের মোবাইল দিয়ে ৩ মাস প্রেম করেছে।
ঘটনার দিন ৪ জুলাই ঘোরাফেরার কথা বলে তাকে ইস্পাহানি ঘাটে ডেকে নেয় আবদুল্লাহ। এরপর বন্দরের বিভিন্ন স্থানে রকিবের ইজিবাইক দিয়ে ঘোরাফেরা করে।
পরে রাত ৮টায় ইস্পাহানি ঘাটে এসে খলিলুর রহমানের নৌকায় উঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঘুরতে থাকে। এক পর্যায়ে নৌকার মধ্যেই আবদুল্লাহ প্রথমে দিশা মনিকে ধর্ষণ করে। এরপর মাঝি খলিলুর রহমানও জোর করে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।
এতে কিশোরী বাগবিতণ্ডায় জড়ালে ক্ষিপ্ত হয়ে খলিলুর রহমান কিশোরীর দুই পা চেপে ধরে আর আবদুল্লাহ গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর দুজনে মিলে কিশোরীকে শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝখানে ফেলে দেয়।
মেয়েটির মায়ের মোবাইলের কললিস্ট চেক করে রকিবের সন্ধান পায় পুলিশ। রকিবের মোবাইল থেকে কিশোরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতো আব্দুল্লাহ। আর এ ঘটনায় আব্দুল্লাহ (২২), রকিব (১৯) ও নৌকার মাঝি খলিলকে (৩৬) গ্রেফতার করে পুলিশ।’
এরইমধ্যে গত ৯ আগস্ট দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবিরের পৃথক আদালতে গ্রেফতার-
তিনজনকে জবানবন্দি দেয়ার জন্য হাজির করে পুলিশ। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনজন বলেন, ‘তারা দিশা মনিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।’
এদিকে রোববার নারায়ণগঞ্জের বন্দরের নবীগঞ্জ রেললাইন এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে দিশা মনি তার মা রেখা আক্তারকে ফোন করে জানায়, সে বেঁচে আছে এবং ভালো আছে।
তবে কিছু টাকার প্রয়োজন। এমন কথায় টাকা পাঠিয়ে উল্লেখিত এলাকায় দোকানটিতে ছুটে যান দিশা মনির মা-বাবা। এছাড়াও এ অবিশ্বাস্য ঘটনায় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুনকে বিষয়টি অবহিত করেন।
এরপর তার বাবা-মা ছুটে যান বন্দর থানাধীন নবীগঞ্জ এলাকার সেই মোবাইল ফোনের দোকানটিতে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মেয়েকে চোখের সামনে দেখে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা ও বাবা।
দিশা মনির বাবা জাহাঙ্গীর আলম জনান, পুলিশ বলেছিল আমার মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে। এ ঘটনায় নির্দোষ ৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
এই দেড় মাসে আমার মেয়েকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। কিন্তু মেয়ে নিজে থেকেই আজ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে আমরা নিয়ে থানায় আসি। আমার মেয়েকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোনো কাজই করেনি।
একটি সূত্র জানায়, বন্দরের কুশিয়ারা এলাকায় ইকবাল ওরফে ইব্রাহিম নামে এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে গত দেড়মাস ধরে বসবাস করছিল দিশা মনি।