সুদের হারের নয়-ছয় সীমা তুলে দেওয়ার পর আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ঋণের সুদহার আড়াই শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। সমান তালে বেড়েছে আমানতের সুদহারও।
এর ফলে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। গত চার মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা মোট নগদ টাকা থেকে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা আমানত হিসেবে ব্যাংকে ফিরেছে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সুদহারের নির্দিষ্ট সীমা তুলে দেওয়ার পর আমানত বাড়ছে। এতে মানুষ ভালো সুদ পাচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফিরছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার মতো তারল্য বাড়ছে। আমাদের ব্যাংকে আমানতে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে। গত চার মাসে বেড়েছে ৩-৪ হাজার কোটি টাকা।’
ব্যাংক থেকে টাকা বাইরে চলে যাওয়া শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণের নতুন নিয়ম চালু করে। সুদের হারের ৯ শতাংশের সর্বোচ্চ সীমা থেকে বের হয়ে স্মার্ট সুদহার নামে নতুন নিয়ম চালু করে। স্মার্ট হলো, সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত জুন মাসে স্মার্ট ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, যা নভেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যোগ করতে পারে। ফলে সুদহার বেড়ে এখন হয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সুদহার নির্ধারণে বেশির ভাগ ব্যাংক কিছুটা অপেক্ষা করলেও এখন পরিবর্তন করছে। কারণ, ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ঋণের সুদহার সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা কমিটি (অ্যালকো) আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে। এ ছাড়া সংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক এখন ১২ শতাংশের বেশি সুদে তহবিল সংগ্রহ করছে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর যা আর জমা হয়নি, তা-ই ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই টাকা মানুষ নিজের কাছে বা কোনো সমিতিতে রাখেন। এভাবে টাকা মালিকের নিজের হাতে কিংবা এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরেছে, ব্যাংকে ফেরেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৯ কোটি। পরের মাস জুনে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসেই ব্যাংকের বাইরে চলে যায় ৩৬ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সুদহার বাড়ানোর ফলে জুলাই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। তা আগস্টে আরও কমে হয় ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ নেমে আসে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৫ কোটিতে, যা অক্টোবরে আরও কমে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকায় নামে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমে আসা। এ ছাড়া আমানতের সুদের হার বাড়ার প্রভাবও পড়েছে ব্যাংকের আমানতের ওপর।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসে ব্যাংকগুলোয় আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯ কোটি টাকা, যা জুন মাসে বেড়ে হয় ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ যুক্ত হয়েছে। ফলে আমানত বেশি বেড়েছে। জুলাই মাসে ব্যাংকে আমানত বেড়ে হয় ১৬ লাখ ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা, যা বেড়ে আগস্টে ১৬ লাখ ১৮ হাজার ৫০৮ কোটি টাকায়, সেপ্টেম্বরে ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায় ও অক্টোবরে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯২ কোটি টাকায় ওঠে।
এদিকে শরিয়াভিত্তিক ও প্রথম প্রজন্মের কিছু ব্যাংক অস্বাভাবিক সুদে আমানত সংগ্রহ করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আমানত বাড়লেও সম্প্রতি শরিয়াভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। এই খবর আলোচনায় আসার পর এসব ব্যাংকে আমানত কমতে শুরু করেছে।