আরেকটি বছর যখন শেষ হওয়ার অপেক্ষায়, তখন স্পোর্টস তুলে আনার চেষ্টা করছে পেছনে ফেলে আসা মণি-মুক্তা। ২০২৩ সালে সারা বিশ্বের জনপ্রিয় সব খেলার সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব মেলানোর পালায় আজ থাকছে বৈশ্বিক ক্রিকেটের সালতামামি –
ক্রিকেটে ২০২৩ ছিল বিশ্বকাপের বছর। অক্টোবর-নভেম্বরে ব্যাট-বলের রোমাঞ্চকর এই বৈশ্বিক আসরের পসরা সাজিয়ে বসেছিল ভারত। মাঠেও দুর্দান্ত দাপট দেখাচ্ছিল রোহিত শর্মার দল। বিরাট কোহলি, শুভমান গিল, মোহাম্মদ সামিদের আলোর রোশনাইয়ে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল সব প্রতিপক্ষ। কিন্তু গ্রুপে শতভাগ সাফল্যের পরও ওয়ানডে বিশ্বকাপটা ভারতীয়দের কাছে করুণ এক শোকগাথার গল্প!
১৯ নভেম্বর বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবে মাতোয়ারা হওয়ার আশায় আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে উঠেছিল নীল সমুদ্রের ঢেউ! কিন্তু সেদিন উৎসবের রংটা নীল না হয়ে হয়েছিল আক্ষরিক অর্থে বেদনার রং। আহমেদাবাদের লাখো সমর্থকের গর্জন থামিয়ে স্তব্ধ ভারতে বিজয় উৎসব করেছিলেন প্যাট কামিনস-ট্রাভিস হেড-গ্লেন ম্যাক্সওয়েল-ডেভিড ওয়ার্নাররা। গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে ফাইনাল মানেই তো অস্ট্রেলিয়ানদের বিজয়ের প্লাবনে ভেসে যাওয়া।
এ নিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ১৩ আসরে আটবার ফাইনাল খেলে ষষ্ঠবার ট্রফি উঁচিয়ে ধরল অস্ট্রেলিয়ানরা। ভারত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায় বিশ্বকাপের পরপর খেলা পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে।অস্ট্রেলিয়ার রাজদণ্ড ভারতের শোকগাথা আহমেদাবাদের ফাইনালে ১২০ বলে ১৩৭ রানের বিস্ফোরক ইনিংসে উড়ে গিয়েছিল ভারতীয়দের বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন। আসরের সর্বোচ্চ ৭৬৫ রান এবং সর্বোচ্চ ২৪ উইকেট শিকার করেও বিরাট কোহলি ও মোহাম্মদ সামিরা পারেননি স্বাগতিকদের ট্রফি এনে দিতে।
শচীন টেন্ডুলকারকে পেছনে ফেলে ওয়ানডের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির কীর্তিও গড়েছিলেন টুর্নামেন্টসেরা কোহলি। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে করেছেন সেঞ্চুরির হাফসেঞ্চুরি। কিন্তু ফাইনালের হারে আড়ালে পড়ে যায় কোহলি-সামি-রোহিতদের ব্যক্তিগত অর্জনের সাজানো ডালি।
অথচ যাদের হাতে ট্রফি উঠেছে সেই অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনাল খেলা নিয়েই তৈরি হয়েছিল ঘোর অনিশ্চয়তা। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে শুরু হয়েছিল কামিনসদের বিশ্বকাপ মিশন। ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষেও হারের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল অজিরা। অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ে ওই খাদের কিনার থেকে টেনে তুলে অস্ট্রেলিয়াকে অসাধারণ এক জয় এনে দিয়েছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। আসরের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরি এবং বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরির কীর্তি গড়ে অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ শিরোপা জয়ের অন্যতম রূপকার ছিলেন মারকুটে ম্যাক্সওয়েল।
এই পঞ্জিকাবর্ষে দ্বিতীয়বার ফাইনালে ভারতবধ করে অস্ট্রেলিয়া। ভারতকে হারিয়েই ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের রাজদণ্ডও জিতেছিল প্যাট কামিনসের দল। প্রথম ইনিংসে নান্দনিক শতরানে অস্ট্রেলিয়ার রাজদণ্ড জয়ের রূপকারও ছিলেন ট্রাভিস হেড। ওয়ানডে বিশ্বকাপে চমকের নাম ছিল আফগানিস্তান। একের পর এক রূপকথা রচনা করে তারা হারিয়ে দেয় তিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন-ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেদারল্যান্ডসকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ৪২৮ রান করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ধর্মশালায় সেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিজয় উৎসব করেছিল নেদারল্যান্ডস। বরাবারের মতো প্রোটিয়াদের দৌড় থেমে যায় সেমিফাইনালেই।
বিশ্বকাপের মুকুট মাথায় ভারতে পা রাখা ইংল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তান বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকে। ব্যর্থ বিশ্বকাপ মিশনের পর তিন ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন বাবর আজম। সাদা বলে ইংল্যান্ডের দুর্দশা বছরের শেষেও। জস বাটলাররা কিছুদিন আগে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে। সেই ক্যারিবীয়রাও পারেনি ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইয়ের গণ্ডি পেরোতে।
বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে না পারলেও এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতেছিল ভারত। হাইব্রিড ফর্মুলায় আসরের অর্ধেকের বেশি ম্যাচ পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কায়। কলম্বোর এশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল শ্রীলঙ্কা ও ভারত। মোহাম্মদ সিরাজের আগুন ঝরানো বোলিংয়ে লঙ্কানদের ৫০ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে ১০ উইকেটের বিশাল জয়ে ট্রফি নিয়ে ফেরে রোহিত শর্মার দল। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো এশিয়া কাপেও ভরাডুবি হয় পাকিস্তানের। ২২ গজের জমিনে বছরজুড়েই সাফল্যের ফুল ফুটিয়েছে অস্ট্রেলিয়ানরা। শুরুটা মেয়েদের সংক্ষিপ্ত সংস্করণে বিশ্বকাপ জিতে। ফেব্রুয়ারিতে কেপ টাউনে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের ঢেরায় হারিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ষষ্ঠ শিরোপা এনে দেন ম্যাগ ল্যানিংয়ের দল। বৈশ্বিক এই আসরে তাদের এটা টানা তৃতীয় শিরোপা।
গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে ২০২৩ সালেও বছরজুড়ে চমক ছিল ছোট দলগুলোর। আফ্রিকান অঞ্চলের বাছাইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পেয়েছে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হয় শ্রীলঙ্কা। অলিম্পিকে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্তির সুখবরটিও চলতি বছরের। ১৯৯২ সালের পর আবার অলিম্পিকে ফিরছে ব্যাট-বলের রোমাঞ্চকর খেলা ক্রিকেট।