আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ গত ৪৫ বছরে প্রথমবারের মতো সীমান্তে ভারত ও চীনের সামরিক সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশ দুটির সম্পর্ক।
লাদাখ সীমান্তে গলওয়ান উপত্যকায় চীনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সতর্ক অবস্থানে আছে দুই দেশের সেনারা। পিছু হটে যাওয়ার কথা বলেও-
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ক্রমশ সেনা সরঞ্জাম মজুত করছে দুই দেশ। ইতোমধ্যে লাদাখ সীমান্তে অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম, ট্যাংক, কামান মজুত করেছে ভারত।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমে সিএনএন জানায়, এর আগে ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে ঠিক ওই একই স্থানে যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল ভারত।
সম্প্রতি ভারতের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা ও চীনের আকসাই চীন সীমান্তের ওই সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনার প্রাণহানি ঘটে।
দুই দেশের মধ্যকার ডি-ফ্যাক্টো সীমান্ত কিংবা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) স্থানে ওই সংঘর্ষ ঘটে। সেখানে দুই দেশের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
চীন-শাসিত ওই বিতর্কিত স্থানটির মালিকানা নিয়ে ভারতের দাবি থাকায় এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে পুরনো বিবাদ রয়েছে।
সম্প্রতি লাদাখে ভারতের তৈরি করা রাস্তা যা দুই দেশের মধ্যকার এলওএসিতে পড়েছে তা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ বাঁধে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
সিএনএনসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবেশী এই দেশ দুটি মধ্যকার সামরিক ক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে চীন নাকি ভারত?
১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর বিগত দশকগুলোতে এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশই বিপুল যুদ্ধাস্ত্রের সম্ভার গড়ে তুলেছে। এতে পরমাণু শক্তিধর দেশ দুটির মধ্যে বিবাদও বেড়ে চলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিং ১৯৬৪ সালে ও ভারত ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠে।
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআইআরপিআই) চলতি সপ্তাহে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ভারতের প্রায় দ্বিগুণের চেয়েও অধিক। এশিয়ার পরাশক্তি দেশ হিসেবে পরিচিত চীনের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে প্রায় ৩২০টি। অপর দিকে ভারতের আছে ১৫০টি।
উভয় শক্তিই তাদের অস্ত্রাগারগুলো গত বছরের তুলনায় এই বছর ভারি করে তুলেছে। বেইজিংয়ের অস্ত্রাগারে নতুন ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র ও নয়াদিল্লির অস্ত্রাগারে নতুন ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র যোগ হয়েছে।
১৯৭৫ সালে শেষবারের মতো ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্ত্র হাতে সংঘর্ষ হয়। তাদের সীমান্তে পারমাণবিক হামলার জন্য-
সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া থাকলেও দুই দেশই এক্ষেত্রে ‘প্রথম ব্যবহারের নীতি’ মেনে চলে। অর্থাৎ যদি এক পক্ষ আগে ব্যবহার করে তবেই অন্য পক্ষ তা ব্যবহার করবে।
এমনকি দেশ দুটির মধ্যে সিদ্ধান্ত রয়েছে, ফ্রন্ট লাইনে যেসব সামরিক সদস্য মোতায়েন থাকবেন, তাদের কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র থাকবে না।
যদি সেনা র্যা ঙ্ক অনুযায়ী কোনো অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার নিয়ম হয়, তাহলে তার নল মাটির দিকে ঘুরিয়ে রাখা থাকবে। সেজন্যই দুই দেশের সেনা সদস্যদের হাতাহাতি বা রড-পাথরের লড়াই হলেও কোথাও গুলি বিনিময় হয় না।
বিমান বাহিনীতে কে এগিয়ে?
বেলফার সেন্টারের মার্চ মাসে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, চীনে আক্রমণের জন্য ভারতের প্রায় ২৭০ যুদ্ধ বিমান ও ৬৮টি স্থল-আক্রমণ বিমান আছে।
ফ্র্যাঙ্ক ওডনেল ও আলেকজান্ডার বোলফ্রাসের লেখা বেলফার সমীক্ষায় বলা হয়, ভারতের সীমান্ত থেকে চীনা সীমান্তের নিকটবর্তী-
ছোট ছোট বিমান ঘাঁটিগুলো তৈরি রাখা আছে। যাতে করে ভারতীয় সেনারা সেখান থেকে খুব সহজে বিমান চালাতে ও অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে।
বেলফার সমীক্ষা মতে, চীনের ১৫৭টি যুদ্ধবিমান ও ওই সীমান্ত অঞ্চলে স্থল-আক্রমণের জন্য ছোট বিমানবহর রয়েছে।
সমীক্ষাটি আরও বলছে, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স (পিএলএএফ) এই অঞ্চলে আটটি ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। তবে এর বেশিরভাগই এতো উচ্চতায় রয়েছে যে বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
বেলফোর সমীক্ষাটি বলা হয়, ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ) তাদের সুখোই এস-৩০ ও মিরেজ-২০০০ যুদ্ধবিমানগুলোর জন্য এই অঞ্চলে সুবিধা পাবে।
কেননা ইন্ডিয়ান মিরেজ-১০০ ও এস-৩০ যুদ্ধবিমানগুলো সব আবহাওয়ায় আঘাত হানতে সক্ষম।
অপর দিকে অঞ্চলটিতে চীনা জেট জে-১০, জে-১১ ও এস-২৭ এর মধ্যে কেবল জে-১০ এরই সব আবহাওয়ায় আঘাত হানার সক্ষমতা আছে।
স্থলবাহিনীতে কার শক্তি বেশি?
মার্কিন সংবাদমাধ্যমে সিএনএনের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ভারত অতীত অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনেকটাই শক্তিশালী।
এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে নয়াদিল্লির আছে সীমিত পরিসরে কাশ্মীরের মতো সীমান্ত অঞ্চলে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর অভিজ্ঞতাও আছে।
অন্য দিকে পিএলএ ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের সঙ্গে সংঘাতের পর থেকে এই ধরনের লড়াইয়ে তেমনভাবে অংশগ্রহণ করেনি। তাই তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও ভারতের চেয়ে কিছুটা কম।
তাছাড়া বেলফারের অনুমান, বিতর্কিত সেই অঞ্চলটিতে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার ভারতীয় স্থলবাহিনী রয়েছে। অন্যদিকে চীনের রয়েছে প্রায় দুই লাখ থেকে ২ লাখ ৩০ হাজারের মতো সদস্য।
এমনকি সেনা সদস্যের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের পিআরডব্লিউ সূচকে তৃতীয় স্থানে আছে চীন। দেশটির সক্রিয় সেনা সদস্য ২১ লাখ ২৩ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়। অপর দিকে ভারতের সেনা সদস্যের সংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ ৪৪ হাজার।
যদিও রিজার্ভ সেনা সংখ্যার দিক থেকে চীনের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। দেশটির রিজার্ভ সামরিক সদস্যের সংখ্যা ২১ লাখ, বিপরীতে চীনের রয়েছে মাত্র ৫ লাখ ১০ হাজার।
বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা:
এশিয়ার পরাশক্তি চীনের কাছে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে ভারত।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন ভারতকে ‘প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দেশের সঙ্গে ভারত প্রায়ই যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনা করে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ততটা নেই বললেই চলে।